আমদানিকারকদের প্রায়শই হয়রানি করেন শুল্ক কর্মকর্তারা—এটিই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা। কিন্তু গত দুই দিন ধরে কমলাপুর অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা যেভাবে কর্মবিরতি পালন করেছেন, তা সাধারণ মানুষের এই ধারণাকে সমর্থন করে না।
পণ্যের চালান খালাস করার আগে শুল্ক কর্মকর্তারা পুনঃপরীক্ষার মাধ্যমে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিদের হয়রানি করেন, এমন অভিযোগের প্রমাণও মেলে না আইসিডির তথ্য-উপাত্তে।
অথচ এই অভিযোগ তুলেই রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি চলছে। সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিরা আমদানি-রপ্তানির শুল্কায়ন-প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন না। সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিরা আইসিডি কমিশনার মারুফুল ইসলাম ও যুগ্ম কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেনের প্রত্যাহার চেয়ে অভিযোগ করেন, তাঁরা (ওই দুই কর্মকর্তা) স্বেচ্ছাচারীভাবে আমদানি পণ্যের প্রতিটি চালান শতভাগ পরীক্ষা করেন। আবার পণ্য খালাসের সময় বেশির ভাগ পণ্যের পুনঃপরীক্ষা করেন। এতে সময় নষ্ট হয়। পণ্যের আমদানি খরচ বাড়ে।
গতকাল সোমবার দুপুরে কমলাপুর আইসিডি প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা গেছে, আইসিডি ভবনের নিচতলায় ৩০-৪০ জন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধি জটলা করে বসে আছেন। এ ছাড়া সাধারণ আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের নামে দাবিদাওয়া সংবলিত ব্যানারও ঝুলছে। তবে ঢাকা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কোনো নেতাকে সেখানে দেখা যায়নি। দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, এই কর্মবিরতির পেছনে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী সিঅ্যান্ডএফ সমিতির বেশ কয়েকজন নেতা রয়েছেন। তবে তাঁরা দৃশ্যপটে আসছেন না।
জানা গেছে, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধির চালান পুনঃপরীক্ষা করেন শুল্ক কর্মকর্তারা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এই কর্মবিরতির নামে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে প্রভাবশালী চক্রটি।
কর্মবিরতি পালন করতে আসা চাঁদপুর ট্রেডিং করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী আমিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার এর মধ্যে নেই। যেসব শুল্ক কর্মকর্তা আমাদের নানাভাবে হয়রানি করেন, তাঁদের প্রত্যাহার চাই।’ তবে সমিতির নেতারা কেন মাঠে নেই—এমন প্রশ্নের উত্তর দেননি তিনি। পুনঃপরীক্ষার পর মিথ্যা ঘোষণার প্রমাণ পাওয়া যায় এমন খবর তাঁর জানা নেই বলে জানান তিনি।
এদিকে গতকাল বিকেলে যোগাযোগ করা হলে আইসিডির কমিশনার মারুফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখনই কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা, তখনই আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। কিন্তু কেউ আসেননি। তারপর সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যার সমাধানে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছি। তাঁরা এখনো যোগাযোগ করেননি।’ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহ সম্পর্কে তিনি জানান, তিনি আইনের কোথাও ব্যত্যয় ঘটাননি।
আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিরা অংশ না নেওয়ায় গত দুই দিনে কমলাপুর আইসিডি থেকে এনবিআর রাজস্ব পায়নি বললেই চলে। এই আইসিডি থেকে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। সেই হিসাবে গত দুই দিনে ১০ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) এক হাজার ২৯২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
পুনঃপরীক্ষায় শুল্ক ফাঁকি প্রমাণিত: আইসিডি সূত্রে জানা গেছে, বিগত চার মাসে (ফেব্রুয়ারি-মে) চার হাজার ২৬টি চালান এসেছে। এর মাত্র ১৭টি চালান পুনঃপরীক্ষা করা হয়েছে, যা মোট চালানের দশমিক ৪২ শতাংশ। এই ১৭টি চালানেই মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আনার প্রমাণ পেয়েছেন আইসিডির কর্মকর্তারা। শুল্কায়ন করার পর পণ্য খালাসের সময় সন্দেহ হলে ওই চালানের পণ্য আবার পুনঃপরীক্ষা করা হয়।
কমলাপুর আইসিডিতে প্রতিদিন আমদানি পণ্যের বিপরীতে ৪০-৫০টি বিল অব এন্ট্রি দাখিল হয়। এর মধ্যে ২০টি শিল্পপণ্যের, আর বাকিগুলো বাণিজ্যিক পণ্যের। তবে শিল্পপণ্যের কোনো পুনঃপরীক্ষা করা হয় না। আবার প্রতিবছর যে পরিমাণ পণ্যের চালান খালাস হয়, এর ৫ শতাংশ চালানও পুনঃপরীক্ষা করা হয় না। অভিযোগ রয়েছে, যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়, তার চেয়ে কম পরিমাণ পণ্য ঘোষণা দেওয়া হয়। এতে রাজস্ব হারায় সরকার। এর সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শুল্ক কর্মকর্তারাও জড়িত থাকেন৷