বাংলাদেশকে সেই কয়েক শতক আগেই বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেছে মসলিন। কালক্রমে এই মসলিনের টিকে যাওয়া একটি ধরন হচ্ছে জামদানি। ঐতিহ্যগতভাবেই জামদানি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। বিভিন্ন দেশে এখনো বাংলাদেশের জামদানির কয়েক শ বছরের পুরোনো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ রয়েছে।
কিন্তু এত কিছুর পরও ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ ২০০৯ সালে জামদানিকে তাদের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করেছে। এর নাম দিয়েছে তারা ‘উপ্পাদা জামদানি’।
তবে জামদানি যেহেতু বাংলাদেশের পণ্য হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত, তাই ভারত জামদানির আগে তাদের কোনো জায়গার নাম বসিয়ে তা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করতে পারে না। এই নিবন্ধন শুধু বাংলাদেশই করতে পারে। যদিও ভারতের এই নিবন্ধন এখনো দেশের জামদানির ওপর প্রভাব ফেলেনি, তবুও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। জামদানি রক্ষায় তাই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপের দিকেও যেতে হবে।
আর এই পদক্ষেপ নিতে হবে ভৌগোলিক নির্দেশক আইনের আওতায়। এ আইনটি গত বছর পাস হলেও বিধিমালা তৈরি না হওয়ায় এটি কার্যকর করা যাচ্ছে না। সরকারকে দ্রুত বিধিমালাটি তৈরি করতে হবে।
‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য সুরক্ষার গুরুত্ব: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত ও করণীয়’ বিষয়ক এক সংলাপে গতকাল মঙ্গলবার এমন মতামত উঠে এসেছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ যৌথভাবে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ সংলাপের আয়োজন করে।
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট এলাকার এমন পণ্য, যা শুধু ওই এলাকাতেই উৎপাদিত কিংবা প্রস্তুত হয়। সংশ্লিষ্ট দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই আইনে এই পণ্যের নিবন্ধন নিতে হয়। এই নিবন্ধন থাকলে ওই পণ্য বিশ্বব্যাপী ওই দেশের কিংবা ওই এলাকার অনন্য পণ্য হিসেবে পরিচিত হয়। ওয়ার্ল্ড ইন্টালেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও) এই জিআইর বিষয়টি বৈশ্বিকভাবে দেখাশোনা করে থাকে৷
ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের নিবন্ধন কেন প্রয়োজন?—সে বিষয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, জামদানিকে যদি সুরক্ষা দেওয়া যায় তাহলে তুলনামূলক বাজার সুবিধা পাওয়া যাবে। বাড়তি দাম পাবেন উৎপাদকেরা। অনন্য পণ্য হিসেবে তখন আরও বেশি দর-কষাকষি করতে পারবেন উৎপাদকেরা।
উদাহরণ দিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ‘আপনি এখন অ্যাপলের মুঠোফোন কেনেন। কোনো দর-কষাকষি করতে পারেন? যত দাম বলে সেই দামেই কিনতে হয়। আমাদের জামদানিটা যদি ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের নিবন্ধন পায় তাহলে আপনিও বাড়তি মূল্য ছাড়া জামদানি বিক্রি করবেন না।’
সিপিডির এই বিশেষ ফেলো আরও বলেন, ‘ভারত উপ্পাদা জামদানি নামে জামদানিকে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করেছে। এখন আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে জামদানি শুধুই আমাদের পণ্য। তা না হলে আমরা আইনি লড়াইয়ে যেতে পারব না।’
জামদানি যে শুধু বাংলাদেশেরই নিজস্ব পণ্য এ নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার ইকবাল। অনুষ্ঠানে গবেষণার মূল দিকগুলো তুলে ধের তিনি বলেন, জামদানি তৈরি করতে যেসব কাঁচামাল, আবহাওয়া, বুননের দক্ষতা প্রয়োজন তা শুধু বাংলাদেশেই আছে। তাই অন্য কোনো দেশ এ পণ্যের মালিকানা দাবিই করতে পারে না।
ইফতেখার ইকবাল বলেন, জামদানিকে মসৃণ করতে যে পানি দরকার তা বাংলাদেশের শীতলক্ষ্যা নদীতে রয়েছে। সে কারণে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী স্থানগুলোতেই জামদানি পল্লি গড়ে ওঠে। তিনি জানান, গবেষণা প্রণয়নের সময় তাঁরা ওসমান গণি নামের একজন জামদানি শাড়ি প্রস্তুতকারকের সাক্ষাৎকার নেন। তাঁকে ভারতের শাড়ি প্রস্তুতকারকেরা সে দেশে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই আবহাওয়া ও কাঁচামালে তিনি বাংলাদেশের মানের জামদানি তৈরি করতে পারেননি।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এ দেশ থেকে ৪৮ লাখ ডলারের জামদানি শািড় রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ লাখ ডলারের জামদানি রপ্তানি হয়েছে শুধু ভারতেই। আর ২০১০-১১ অর্থবছরে এক কোটি চার লাখ ডলারের জামদানি রপ্তানি হয়, যার মধ্যে ভারতেই গেছে ৬১ লাখ ডলারের জামদানি। দেশের তিন হাজার পরিবারের ১৫ হাজার মানুষ জামদানি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। প্রতি সপ্তাহে দুই হাজার জামদানি শাড়ি দেশে প্রস্তুত হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) জ্যেষ্ঠ গবেষক আবু ইউসুফ। ভারত জামদানির নিবন্ধন নেওয়ায় এ দেশের জামদানির ওপর এর কোনো প্রভাব পড়েছে কি না—জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের জামদানির ওপর এখনো এর প্রভাব পড়েনি। বাইরে এ দেশের জামদানির চাহিদা প্রবল। এমনকি এ দেশ থেকে যত জামদানি রপ্তানি হয় তার অর্ধেকেরও বেশি যায় ভারতে। ভারতীয়দের কাছেও তাদেরটার চেয়ে বাংলাদেশের জামদানির চাহিদাই বেশি।
তাহলে সমস্যা কোথায়?—জানতে চাইলে আবু ইউসুফ বলেন, ‘জামদানি যে বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য তা সবাই জানে। কিন্তু নিবন্ধন না থাকায় কাগজে-কলমে তা কোথাও নেই। সে জন্যই নিবন্ধন হওয়া প্রয়োজন। ভারত আজ উপ্পাদা জামদানি বলছে, কিছুদিন পর তারা শুধু জামদানি নামেও তো নিবন্ধন নিয়ে নিতে পারে। আবার বাংলাদেশের জামদানির নিবন্ধন করা থাকলে বিশ্বের কোথাও যদি এ শািড় নকল করে বাজারজাত করা হয় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। কিন্তু নিবন্ধন না থাকায় এখন তা করা সম্ভব না।’
সরকার এ ক্ষেত্রে কী করছে?—এ বিষয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) কর্মকর্তা সেলিম চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন আমাদের কোনো ভৌগোলিক নির্দেশক আইন ছিল না। গত বছর আইনটি সংসদে পাস হয়েছে। কিন্তু এই আইনটি কার্যকরভাবে প্রয়োগের জন্য বিধিমালা প্রয়োজন। বিধিমালার একটি খসড়া তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন পক্ষের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এটি হলেই জামদানিসহ বিভিন্ন পণ্যের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হবে।
অনুষ্ঠানে আইনজীবী শুক্লা সারওয়াত সিরাজ ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের আইনগত বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ মিলে একটি পারস্পরিক চুক্তি (রিসিপ্রোকাল ট্রিটি) করে আলোচনার মাধ্যমে নিজেরাই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। তাহলে বিষয়টি নিয়ে আর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউওটি) যেতে হবে না।
প্রসঙ্গত, ডব্লিউটিওতে একটি বিবাদ নিষ্পত্তি বিভাগ (ডিসপিউট সেটেলমেন্ট বডি) আছে। সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যদি কোনো বিষয় নিয়ে বিবাদ দেখা দেয় তখন সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এর নিষ্পত্তির জন্য এই বিভাগে যায়।
ইফতেখার ইকবালের গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি পরামর্শক দলের দিকনির্দেশনায়। ওই দলে আছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান (আসক) হামিদা হোসেন। সংলাপ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘দেশে কোনো বস্ত্র জাদুঘর নেই। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে বাংলাদেশের মসলিন ও জামদানির কাপড় এবং এর বুননশৈলীর চিত্র সংরক্ষিত আছে। জাদুঘর না থাকায় এসব বিষয় আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।