গান শোনার শুরুটা কবে মনে নেই। তবে শিখতে শুরু করেছি সাত বছর বয়সে। গানের শিক্ষক বাড়িতে এসে শেখাতেন। প্রথম গলায় তুলেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান–‘অমল ধবল পালে লেগেছে…।’ সেই শিক্ষকের কাছে দুই বছর শিখেছিলাম। তাঁর কাছে শেখা শেষ গান, ‘এসো নীপবনে…।’ শুরু রবীন্দ্রনাথ, আবার শেষও সেই রবীন্দ্রনাথেই। এরপর বাবার চাকরির বদলির কারণে আমরা শিলং শহরে চলে গেলাম। গান আর শেখা হলো না। কিন্তু আগ্রহটা রয়েই গেল। অনেক ধরনের গানই ভালো লাগত। তবে বিশেষ আকর্ষণ ছিল রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতির প্রতি৷ শাস্ত্রীয়সংগীতের প্রতি তেমন কোনো ভালোবাসা ছিল না।
সতি্য বলতে, সে বয়সে শাস্ত্রীয়সংগীতের কিছু বুঝতাম না!
যখন একটু বড় হলাম, কলেজে যেতে শুরু করলাম; তখন হিন্দি চলচ্চিত্রের গানগুলো খুব ভালো লাগত। খুব শুনতাম সেই সব গান। লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোসলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান খুব ভালো লাগত। এ ছাড়া প্রিয় শিল্পীদের মধ্যে আরও ছিলেন পংকজ কুমার মল্লিক, শচীন দেববর্মন ও জগন্ময় মিত্র।
একটা সময়ে দেশের বাইরে চলে গেলাম। তখন তো আর যেমন ইচ্ছে তেমনি গান শোনার উপায় রইল না। সঙ্গে করে কিছু রবীন্দ্রসংগীত আর হিন্দি গান নিয়ে গিয়েছিলাম। জীবনের পথে পথে রবীন্দ্রনাথ সব সময়ই আমার সঙ্গে ছিলেন। তাঁকে পাশে পেয়েছি স্বজনের মতো! এখন রবীন্দ্রনাথের একটি গান প্রায়ই হৃদয় স্পর্শ করে। ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই, প্রহর হলো শেষ।’ এ ছাড়া পূজা পর্যায়ের গান, প্রকৃতির গান খুব ভালো লাগে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন ঋতু নিয়ে লেখা গানগুলোর মুগ্ধ শ্রোতা আমি। এখন তো বর্ষাকাল, ইদানীং ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এল আমার মনে…’ গানটা খুব শোনা হচ্ছে। বৃষ্টির দিনে এ গানটা না শুনলে চলে না।
আমার গান শোনার সময় ভোর আর গভীর রাত। গাড়িতে যানজটে বসে কিংবা আইপডে গান শুনে সময় কাটাই। গান শোনায় কোনো ক্লান্তি নেই। এখন মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে ভাবি, কত কিছুই বদলেছে যুগের সঙ্গে! গান শোনার ব্যাপারটা ধরুন, কত সহজে চাইলেই শোনা যায়। আগে তো গান শোনার ঝক্কি কম ছিল না। এটা যেমনি শখের ব্যাপার, তেমনি জোগাড়-যন্ত্র করাও খুব কষ্টসাধ্য ছিল। ভালো গান শুনতে হলে সেটা জোগাড় করতে হতো। একটি রেকর্ড ৭৮ আরপিএমের দুই পিঠে মাত্র দুইটা গান থাকত। পিন দিয়ে শুনতে হতো। তারপর এল ৩৩ আরপিএম, যার একপিঠে ১৫ কি ২০ মিনিট গান চলত। মানে পুরো রেকর্ডটা ঘণ্টা খানেক চালানো যেত। তারপর এল রেডিওগ্রাম। সেখানে অনেক গান শোনা যেত। এরপর এল রেডিও। সেখানে কলকাতার অনুরোধের আসর নামে একটা গানের অনুষ্ঠান হতো। এই অনুষ্ঠানটা নিয়ম করে শুনতাম। আর এখন ভাবলেই আশ্চর্য লাগে, আমার নিজের আইপডেই পাঁচ হাজার গান আছে! শোনার জন্য একটা নব চাপলেই যথেষ্ট। যেমন খুশি তেমনি গান শোনা যায়। এক জীবনে কত কী দেখলাম!
শুরুতে বলেছিলাম উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রতি আমার আগ্রহ ছিল না! অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যেন আমার ভেতরের শ্রোতামনটাও পাল্টে গেছে। অবাক হয়ে লক্ষ করছি, উচ্চাঙ্গসংগীত ভালো লাগতে শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, এই গানের ভেতরের মানে, গানের ভেতরের গোপন বাণী বুঝতে শুরু করেছি। উপলব্ধি করেছি গানের অসীম ক্ষমতা!