জনতার কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ

awami-league-flag_SwadeshNews24২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের এইদিনে সংগঠনটি তার যাত্রা শুরু করেছিল। ৪৭’ এর দেশ বিভাগের পর থেকে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায়ে উচ্চকিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ।

সবশেষে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়ের মধ্য দিয়ে পরাধীনতার অবসান ঘটে এই আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। কিন্তু ইতিহাসের ৬৫ বছরে নানা বির্তকে বার বার দলটিকে জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে।

গৌরবময় অতীত ও বর্তমান নিয়ে বাংলাদেশের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে আওয়ামী লীগ।

সেই সূত্র ধরে, আওয়ামী লীগ আজও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া, আওয়ামী লীগ এখন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের যাত্রা ও বিরোধী দলের উত্থান
১৯৪৭ সালে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্বে’র ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামের একটি কৃত্রিম রাষ্ট্র। ধর্মভিত্তিক বিভক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট পাকিস্তান ছিল দুই খণ্ডে বিভক্ত- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। দুই পাকিস্তানের মাঝে ছিল হাজার মাইলের ব্যবধান। দুই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের ভাষা ছিল ভিন্ন, সংস্কৃতিতে ছিল আকাশ-পাতাল তফাত। এর উপর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতি বাঙালিদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তার উন্মেষ ঘটায়।

এমন বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ৪ মাস ২০ দিনের মাথায়, তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জন্ম নেয় বিরোধী ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’। পরের বছরের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেন-এ অবস্থিত রোজ গার্ডেনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত নেতাকর্মীদের এক বৈঠকে আত্মপ্রকাশ করে নতুন রাজনৈতিক দল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’।

নবগঠিত এই দলটির সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শামসুল হক হন সাধারণ সম্পাদক। এতে যুগ্ম-সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল ছিল এটি। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে দলটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়।

ভাষা আন্দোলন
পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বাঙালি প্রথম বিদ্রোহ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত চলা এই ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। এক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয় অবরোধ কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কয়েকজন অনুসারীর সাথে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব।

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন
১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে, পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন হিসেবেই অধিক পরিচিত। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ঐতিহাসিক জয় পায় যুক্তফ্রন্ট।

নির্ধারিত ৩০৯টি আসনের মাঝে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয় ৩০০ আসনে, আর মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন। এর ফলে মুসলিম লীগ শুধুমাত্র পরাজিতই হয়নি, বরং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে মুসলিম লীগের নাম প্রায় মুছে যায়। এটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের একটি ভোট বিপ্লব।

সরকার গঠন, দলে ভাঙন ও ক্ষমতা হরণ
যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে যাওয়ার পর, ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন আতাউর রহমান খান এবং শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রমবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে আরও বেশি সময় দেয়ার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন শেখ মুজিব। তিনি সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে মাঠে নামেন। ঠিক সেই সময়ই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থেকে মাত্র ১৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় নতুন সরকার।

একই সময়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা ভাসানী ছিলেন জোট-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে, অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট গঠনের পক্ষপাতী। এই বিরোধের জেরে ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন মাওলানা ভাসানী এবং কয়েকদিনের মাঝে দলের ওয়ার্কিং কমিটির ৩৭ জন সদস্যের ৯ জনই ভাসানীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। এমন সঙ্কটময় অবস্থায় এগিয়ে আসেন শেখ মুজিব। মূলতঃ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়ই প্রায় নিশ্চিত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায় আওয়ামী লীগ।

আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। এর ২০ দিনের মাথায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর তৎকালীন প্রধান আইয়ুব খান পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। এভাবেই শুরু হয় আইয়ুব খানের এক দশকব্যাপী সামরিক শাসন।

তার কঠোর দমননীতি সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ তার কার্যক্রম গোপনে চালিয়ে যেতে থাকে। একই সঙ্গে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনও ক্রমশঃ জোরদার হতে থাকে। এই আন্দোলন আরও দুর্বার হয়ে ওঠে যখন ১৯৬২ সালের জুন মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই সংবাদ শোনার সাথে সাথে ক্ষোভে ফেটে পড়ে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান, রাস্তায় নেমে আসে লাখো ছাত্র-জনতা। ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি, পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনকে ঘিরে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন আরো জোরদার হয়। একই সাথে আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যবস্থার অন্তঃসারশূণ্যতা প্রমাণিত হয়।

১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
১৯৬৪ সালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের আদমজীসহ বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম ও হিন্দুদের মাঝে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে বাঙালি ও বিহারীদের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনা শুরু হওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে। দাঙ্গায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছিল এবং অবাধে চলছিল লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। দাঙ্গায় গৃহহীন হয়ে পড়ে শত শত মানুষ। সরকারবিরোধী মনোভাব অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য ওই সময় আইয়ুব সরকার এই দাঙ্গাকে আরও উৎসাহিত করে।এমন সময় আওয়ামী লীগ ‘প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করে, যা বিভিন্ন দাঙ্গা উপদ্রুত অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করে।

ছয় দফা কর্মসূচি
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ বাঙালির চোখ খুলে দেয়। যুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তান সমগ্র বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। শাসকগোষ্ঠী ব্যস্ত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষায়। এমতাবস্থায় যুদ্ধ শেষে, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা নিয়ে সরব হন। ছয় দফা ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্তির একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক সনদ। এই ছয়টি দফা হলো-

প্রথম দফা – পাকিস্তানের সরকার হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা প্রত্যক্ষ ও সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে।

দ্বিতীয় দফা – যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে থাকবে কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়াদি।

তৃতীয় দফা – দেশের দুইটি অঞ্চলের জন্য দুইটি পৃথক অথচ সহজেই বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। এক্ষেত্রে দুই অঞ্চলে একক মুদ্রাও থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে ফেডারেল ব্যাংককে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

চতুর্থ দফা – রাজস্ব সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব এবং কর ধার্যের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারগুলোর থাকবে। দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় পরিচালনার জন্য আদায়কৃত রাজস্বের অংশবিশেষ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়া হবে।

পঞ্চম দফা – বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক হিসাব রাখতে হবে। প্রাদেশিক সরকারগুলো বিদেশের সাথে বৈদেশিক নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাণিজ্যিক চুক্তি করতে পারবে।

ষষ্ঠ দফা – কার্যকরভাবে জাতীয় নিরাপত্তায় অংশগ্রহণের জন্য প্রদেশগুলোকে প্যারামিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দেয়া হবে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান
ছয় দফা দাবির প্রতি ক্রমবর্ধমান জনসমর্থনকে দাবিয়ে রাখতে নতুন এক ফন্দি আঁটেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে এক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। যেখানে ৩৫ জন বাঙালি সরকারি কর্মচারী এবং সামরিক কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য” নামের এই মামলায় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রধান আসামি। অভিযুক্তদের বিচার করার জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন।

এই মামলার ফলে ক্ষোভে ফুঁসে উঠে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে ছাত্রসমাজ। হাজার হাজার ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে, ব্যারিকেড ভেঙে রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের স্লোগান ছিল, “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো। তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব”। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বিক্ষুব্ধ জনগণের উপর গুলিবর্ষণ করে। এই আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন অনেকেই।

এদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আসাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সামসুজ্জোহা, স্কুল ছাত্র মতিউর ও সার্জেন্ট জহুরুল হক অন্যতম। অবশেষে ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এর পরের দিন রেসকোর্স ময়দানে এক আড়ম্বরপূর্ণ সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিব কে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং আইয়ুব শাহীর একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে।

১৯৭০ সালের নির্বাচন : আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়
আইয়ুব খানের পর ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া খান। এসেই তিনি ডিসেম্বর মাসে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ১৯৭০ এর ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে। ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনেই জয় পায় আওয়ামী লীগ। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামীলীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৭টি এবং জাতীয় পরিষদের ১০টি মহিলা আসনেও আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। সর্বমোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করার মাধ্যমে আওয়ামীলীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অপরদিকে জুলফিকার আলীর পাকিস্তান পিপলস’ পার্টি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৮৮টি আসনে জয়লাভ করে।

অসহযোগ আন্দোলন, ৭ই মার্চের ভাষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি
১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক সাফল্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে ভীত করে তোলে। তারা বুঝতে পারে যে বাঙালিরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলেই ৬ দফার ভিত্তিতে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে। তাই নির্বাচনের পরই তারা বাঙালিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকেন। কিন্তু ১লা মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত বন্ধ রাখা হয়। কারফিউ ভেঙে দেশব্যাপী হরতাল পালন করা হয়। বিক্ষোভকারীদের উপর গুলিবর্ষণ করে পাক সেনারা। এতে অনেকেই হতাহত হন। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে ছাত্র জনতার এক বিশাল সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ গঠন করা হয় এবং দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের অলিখিত সরকার প্রধানে পরিণত হন। তার নির্দেশে সকল সরকারি এবং বেসরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সচিবালয়, আদালত, পুলিশ, রেডিও, টেলিভিশন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার কার্যক্রম চলতে থাকে।

৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লাখো মানুষের এক বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। তিনি বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ
ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু এই আলোচনা ছিল বাঙালিদের সাথে প্রতারণার এক কৌশলমাত্র। এই আলোচনার ফাঁকে গোপনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুল অস্ত্র এবং গোলাবারুদ এনে পূর্ব পাকিস্তানে জমা করতে থাকে। ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাক সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় “অপারেশন সার্চলাইট” নামে ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার। হত্যাকাণ্ড শুরুর কিছুক্ষণ পরই, ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণাটি ঢাকা এবং চট্টগ্রামে দলের নেতাকর্মীদের কাছে ইপিআর-এর ওয়্যারলেস এর মাধ্যমে গোপনে পৌঁছানোর ব্যাবস্থা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ, শুরু হয় মুক্তিসংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই পাক সামরিক জান্তা তাঁকে তাঁর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর কিছুদিন পর ১০ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা এক বিবৃতি দেন। এই বিবৃতি স্বাধীনতার সাংবিধানিক ঘোষণা নামে পরিচিত। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার গণপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং লাখো সাধারণ মানুষের সামনে শপথ গ্রহণ করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে সদ্যগঠিত এই সরকার। মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর পুরোদমে দেশব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিবাহিনী দেশজুড়ে পাকবাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ শুরু করে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদেরকে তাদের সেনানিবাসের ভেতর আটকে ফেলে। ৩রা ডিসেম্বর পাকবাহিনী মরিয়া হয়ে ভারতের উপর বিমান হামলা চালায়। এর ফলে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনী এই দুই বাহিনী মিলে মিত্রবাহিনী গঠন করে পাক সেনাবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ভারত। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এর ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মলাভ করে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশ পুনর্গঠন
স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার নানাবিধ বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়। পাক বাহিনীর হামলায় যাতায়াত ব্যাবস্থা এবং শিল্প কারখানাগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়, স্কুল, কলেজ, খাদ্য গুদাম গুলো সম্পূর্ণরূপে পুড়ে যায়।

এছাড়াও ছিল শহীদ পরিবারগুলোর পুনর্বাসন এবং এক কোটি শরণার্থী যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের ফিরিয়ে আনা এবং তাদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত সমস্যা। দেশের অর্থনীতি পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়েছিল, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছিল শূণ্যের কোঠায়। এমনকি খাদ্য গুদামগুলিও পুরোপুরি খালি হয়ে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষ ছিল অবশ্যম্ভাবী। ১৯৭২ সালের খরা, ১৯৭৩ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী মন্দা এবং ১৯৭৪ সালের বন্যা সার্বিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। নবগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি ছিল স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিসমুহের নানাবিধ ষড়যন্ত্র।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখ দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। এরপর থেকেই তিনি দেশ পুনর্গঠনের কাজে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৪ সালে যখন দেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, তখন স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তিকে একই ছাতার নিচে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন বঙ্গবন্ধু। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালের ২৪শে জানুয়ারি গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। জাতির জনক ঘোষণা দেন দ্বিতীয় বিপ্লবের যার মাধ্যমে তিনি দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা এবং এই সাথে জাতীয় ঐক্য পুনর্নির্মানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এর ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলার প্রভূত উন্নতি হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমে আসে, দেশে ফিরে আসে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।

যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ, এমন সময় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘটে যায় ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ড। সপরিবারে হত্যা করা হয় বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সহায়তায় কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা এবং প্রতিক্রিয়াশীল আর্ন্তজাতিক শক্তির এদেশীয় দোসররা মিলে ঘটায় বাঙালি জাতির ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ড।

এরপর ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বদান। ৯৬’ এ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহণ। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে আবারো নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের ইতিহাস সবারই জানা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *