কলকাতার মেট্রো (পাতাল ট্রেন) রেলপথে চলাচলকারী দমদমগামী একটি ট্রেনের পুরোনো রেক গতকাল সোমবার বেলা ১১টা ২৫ মিনিটে বিদ্যুত্সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অচল হয়ে পড়ে। এতে ময়দান ও পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের মাঝখানে ৬০০ যাত্রী নিয়ে আটকা পড়ে দমদমগামী ট্রেনটি।
এ সময় ট্রেনের আলো ও পাখা সব বন্ধ হয়ে যায়। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আটকা পড়া ট্রেনের যাত্রীদের অনেকের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। অন্তত দুজন তরুণী অচেতন হয়ে পড়েন।
তবে মেট্রো কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, এ বিপর্যয় মোকাবিলায় পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে তাদের একটি ব্যবস্থাপনা দল অপেক্ষা করছিল। প্রশ্ন উঠেছে, তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে যাত্রীদের সরিয়ে নিতে কেন সোয়া এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগল? যাত্রীরা অভিযোগ করেন, গুটি কয়েক নিরপত্তাকর্মী ছাড়া সেখানে তাঁদের সহযোগিতার জন্য কেউ ছিল না। কী ঘটছে—তা কেউ জানায়নি তাঁদের। আতঙ্কিত যাত্রীদের আশ্বস্ত করতে মেট্রোর পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। উদ্ধার পেতে ব্যাকুল যাত্রীরা অন্ধকারের মধ্যে চালকের দরজায় আঘাত করতে শুরু করেন।
কলকাতা মেট্রোরেলের যাত্রীদের হরহামেশাই এ ধরনের দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আপত্কালীন পরিস্থিতিতে যাত্রীদের উদ্ধারে যে পরিকাঠামো থাকার কথা, তা যে ভেঙে পড়েছে, গতকালের ঘটনায় তা সুস্পষ্ট। একজন যাত্রী ময়দান পুলিশ স্টেশনে এ নিয়ে অভিযোগ করেছেন। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ট্রেনের এক যাত্রী বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের আর মেট্রোরেলে করে স্কুলে নিয়ে যাব কি না, তা ভাবতে হবে।’ আরেক নারী যাত্রী বলেন, ‘ট্রেনের ভাড়া যেহেতু বাড়ানো হয়েছে, তাই রেল কর্তৃপক্ষকে এখন আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে।’
মেট্রোরেলওয়ের সিপিআরও আর এন মহাপাত্র বলেন, ‘পাবলিক অ্যানাউন্সমেন্টের ঘোষণা অনুযায়ী আমরা যাত্রীদের সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। চিকিত্সকসহ আমাদের সংকট ব্যবস্থাপনা দল সেখানে উপস্থিত ছিল। কিছু যাত্রীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। এর মধ্যে একজন অ্যাজমা রোগী ছিলেন। তবে অন্য কারও তেমন চিকিত্সার প্রয়োজন পড়েনি।’
মেট্রোর একজন কর্মকর্তা জানান, যাত্রীদের ট্রেন থেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দুজন মোটর-কর্মী পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন যে তৃতীয় বগিতে বিদ্যুত্সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ট্রেনটি যাতে আপনা-আপনি চলতে না পারে, এ জন্য কারিগরিভাবে তা ঠেকানো হয়। এ ছাড়া দুর্ঘটনা রোধে আরও কিছু কাজ করা হয়। পরে পিএ সিস্টেমের মাধ্যমে যাত্রীদের পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো হয়। এরপর জরুরি দরজা দিয়ে তাঁদের বের করে নিয়ে আসা হয়।
মেট্রোরেল সূত্রের বরাত দিয়ে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার জানায়, প্রায় কুড়ি বছরের পুরোনো ওই রেকটি কারশেড থেকে বের হওয়ার সময় এটার কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি ধরা পড়েনি। কিন্তু ময়দান স্টেশন ছাড়ার পর চালক টের পান, মেট্রোর বৈদ্যুতিক সংযোগে গোলযোগ হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জরুরি ব্রেক কষেন। দাঁড়িয়ে পড়ে ট্রেন। তার পর অনেক কসরত করেও ট্রেনটিকে চালাতে না পেরে চালক নিয়ন্ত্রণকক্ষে বিষয়টি জানান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো ট্রেনের বিদ্যুত্সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
অর্ণব চক্রবর্তী ও ধীরেন্দ্র নাথ ঘোষ নামের দুজন যাত্রী জানান, দুর্ঘটনার আধা ঘণ্টা পর প্রথম ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে এর মধ্যে যে উদ্ধারকাজ শুরু হয়েছে, তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না।
মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানায়, যাত্রীদের বের করে আনার আগে ট্রেনটি পুনরায় চালু করার চেষ্টা করা হয়েছে। জরুরি বহির্গমন দরজা খুলে দেওয়ার পরও যাত্রীরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আপত্তি করছিলেন। যাত্রীরা থার্ড রেইল নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন। প্রথম জন নামার পর ৪৫ মিনিটের মধ্যে সব যাত্রী নেমে আসতে সক্ষম হন।
নিয়ম অনুযায়ী, মাটির নিচে সুড়ঙ্গ দিয়ে যখন ট্রেন চলে, তখন কোনো রেকের আটকে যাওয়া বা অন্য কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা মাথায় রেখে মেট্রোর টাস্কফোর্স বা উদ্ধারকারী দলকে পুরোপুরি তৈরি রাখার কথা। কিন্তু সোমবার সেই টাস্কফোর্স আদৌ প্রস্তুতই ছিল না। ফলে এদিক-ওদিক থেকে কর্মী পাঠাতে গিয়ে সময় লেগেছে বলে মেট্রোরেল সূত্রের খবর। এ ধরনের উদ্ধারকারী দল কতটা প্রস্তুত, তা দেখতে মাঝেমধ্যেই মহড়া দেওয়ার কথা। কিন্তু তা মেট্রোরেলে মানা হয় না বলে অভিযোগ।