বাজার অভিযানটির উদ্দেশ্য ছিল, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা। যেন পবিত্র রমজান মাসের বাকি দিনগুলোয় রোজাদারেরা একটু কম দামে কিছু প্রয়োজনীয় তরিতরকারি কিনতে পারেন। কিন্তু হলো হিতে বিপরীত। ভোক্তাদের নয়, রক্ষা হলো ব্যবসায়ীদের স্বার্থ।
কারওয়ান বাজারে গত শুক্রবার সারা দিনই প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হয় মানভেদে ৫৫ থেকে ৮০ টাকায়। শসা বিক্রি হয় ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। দুটো পণ্যের দাম আগের তুলনায় বেশ কমে যায়। রমজানের আগের দিন মানভেদে বেগুন ৮০ থেকে ১০০ টাকা আর শসা ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়। এগুলো খুচরা দর।
কিন্তু শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কারওয়ান বাজারে যৌথভাবে অভিযান চালাতে যায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) এবং জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযান শেষে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন খুচরায় প্রতি কেজি বেগুন ৯০ থেকে ১০০ টাকা, শসা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং কাঁচা মরিচ ৫০ টাকা করে বিক্রির দর ঘোষণা করেন।
অর্থাৎ এ অভিযানের মাধ্যমে বাজারে যে দামে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছিল তার চেয়ে বেশি দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এই দাম নির্ধারণে লাভবান হয়েছেন ব্যবসায়ীরাই। ইতিমধ্যেই বাজারে এর প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে। এতে ঠকছেন ক্রেতারা।
পাইকারি বাজার বসেই মধ্যরাতে। সে কারণে অভিযানটিও পরিচালিত হয় মধ্যরাতে। সেদিক থেকে অভিযানটির উদ্দেশ্য ছিল ভালো। কিন্তু এই ভালো উদ্যোগে লাভ হলো না ক্রেতাদের।
অভিযানে অংশ নেওয়া কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওই খুচরা মূল্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা পালন করেছে এফবিসিসিআই। ব্যবসায়ীরা যেমন চেয়েছেন এফবিসিসিআইও সেভাবেই খুচরা মূল্য ঘোষণা করেছে। আবার অভিযানে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি ছাড়া আর কারও কাছে ওই দিনের পণ্যমূল্যের কোনো তথ্য-পরিসংখ্যানও ছিল না।
বাজারে যে দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি খুচরা মূল্য নির্ধারণ কীভাবে হলো—জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল হোসেন মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যে আমার পক্ষে উপস্থিত থাকা সম্ভব ছিল না। সে কারণে আমি একজন প্রতিনিধি পাঠাই। আমাদের প্রতিনিধির কাছে তো পণ্যের মূল্যের কোনো পরিসংখ্যান ছিল না। এই পরিসংখ্যান না রেখে তো দাম নির্ধারণ করা যায় না। আমাদের প্রতিনিধি তাই শুধু দেখেছে কি হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এফবিসিসিআই পুরো কাজটি করেছে।’
কিন্তু বাজারদরের চেয়ে বেশি দাম নির্ধারণ করায় ভোক্তারা ঠকবেন কি না—জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ‘তা তো হবেই। আরও যাচাই-বাছাই করে এই কাজটি করা উচিত ছিল।’ তবে বরাবরের মতো রমজানের মাঝামাঝিতে এসে দাম কমে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যৌথ অভিযানে শুক্রবার রাতে বেগুন, শসা ও কাঁচা মরিচের যে খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, প্রতি কেজি বেগুনে মানভেদে অন্তত ৩০ টাকা, আর শসায় ১০ থেকে ১৫ টাকা মুনাফার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
এই দর নির্ধারণের ফলে গতকাল শনিবার বেগুন আর শসার দাম আবারও চড়ে গেছে। কালো বেগুন ৯০ টাকা এবং গোল বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারে শসা ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা মরিচের দামে অবশ্য হেরফের হয়নি। বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে।
অভিযানের রাতে উপস্থিত ছিলেন—এমন কয়েকজন পাইকারি ব্যবসায়ীর সঙ্গে গতকাল কথা হয় কারওয়ান বাজারে। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, অভিযানের আগে তাঁরা লম্বা বেগুন বিক্রি করেছেন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে।
এত মুনাফা রেখে কীভাবে খুচরা মূল্য ঘোষণা করেছেন—জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাইকারি বাজারে ওই দিন ৭৫ টাকা কেজিতে লম্বা বেগুন বিক্রি হয়েছে। সেই বেগুনটাই আমরা বলেছি ৯০ টাকার বেশি দামে না বেচতে।’
তাই বলে প্রতি কেজিতে ১৫ টাকা মুনাফা? কী করে তা সম্ভব?—জানতে চাইলে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘এইটুক মুনাফা অযৌক্তিক না। কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ীদের ৩০ হাজার টাকা দোকান ভাড়া দিতে হয়।’ সেই দোকান ভাড়াসহ তো ৭৫ টাকায় বেগুনটা পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে। সেই বেগুন খুচরায় কেন ৯০ টাকায় বিক্রি হবে?—এ বিষয়ে তাঁর জবাব, ‘ব্যবসায়ীরা কয়টা টাকা না পেলে তো তারা এই বেগুন বিক্রি করবে না। আর কৃষকও ভালো দাম পাবে না।’
আপনারা শুধু ব্যবসায়ীদের দিকটাই দেখলেন?—এমন মন্তব্য করলে হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি তো একই সঙ্গে ভোক্তাও। আমিও তো বেগুন কিনি। খোলাখুলিভাবে বলি, রমজানে এত দাম দিয়ে বেগুন না খেলে কী হয়?’ তবে বিষয়টি শুক্রবার রাতে গণমাধ্যমের সামনে বললেন না কেন, জানতে চাইলে এর কোনো জবাব মেলেনি।