১/১১ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শুরু হয় ৭১ এর মানবতাবিরোধীদের বিচারকার্য। প্রথম দফায় ক্ষমতার শেষ মেয়াদে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা’র (কসাই কাদের) ফাঁসি হয়। এতে দেশজুড়ে সহিংসতা চালায় জামায়াত-শিবির।
এ সহিংসতা-নৈরাজ্যে পুলিশসহ সারাদেশে লাশের মিছিলে একে একে যুক্ত হয় নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। পরবর্তী অপরাধীদের বিচার কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদেও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। তবে দশম এই ‘নির্বাচনে’ বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট অংশগ্রহণ করেনি। দলটি টানা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর একে একে বেশ কয়েকটি জেলায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের হাত ধরে যোগদান করেন। এতে দলটির বিতরে-বাইরে আলোচনা সমালোচনা ঝড় উঠে। কিন্তু এত কিছুকে ছাপিয়ে পবিত্র রজমান মাসে ইফতার রাজনীতির আড়ালে আবারো প্রকাশ্যে আসছে জামায়াত। কোথাও কোথাও ইফতারের আগ মুহূর্তে আলোচনায় অংশ নিয়ে শিবিরের নেতাকর্মীরা সরকার পতনের হুমকি দিচ্ছে।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈরি রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আড়ালে চলে যাওয়া জামায়াত প্রায় ছয় মাস পর প্রকাশ্যে ফিরে এল। গত বুধবার রাজধানীর গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনে কূটনীতিকদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে হাজির হলেন শীর্ষ স্থানীয় একজন নেতাসহ মধ্যম সারির কয়েকজন নেতা। অনেক দিনের আত্মগোপন দশা থেকে এসে দলটির নেতারা কূটনীতিকদের বার্তা দিলেন জামায়াত নীতিগতভাবে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী ও গণতন্ত্র চর্চার রাজনীতিই করতে চায়। দলটির শীর্ষ নেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডসহ শাস্তির মুখোমুখি হলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় থেকে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত ও কূটনীতিকদের কাছে তুলে ধরলেন জামায়াত নেতারা। শুধু তাই নয়, এজন্য কূটনীতিকদের কাছ থেকে সহযোগিতাও চেয়েছেন দলটির নেতারা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জামায়াতের অনুষ্ঠানে বিদেশি বিশেষ করে পশ্চিমা কূটনীতিকদের উপস্থিতি চোখে পড়েনি। তবে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ও পরবর্তীতে জরুরি অবস্থার দুই বছর পশ্চিমা কূটনীতিকদেরকে জামায়াতের সাথে যোগাযোগ রাখতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদে কোনঠাসা হয়ে যাওয়া জামায়াতকে এড়িয়ে চলতে দেখা গেছে পশ্চিমা কূটনীতিকদের। বিশেষ করে গত বছরের সরকার বিরোধী সহিংস আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তারা জামায়াত বিরোধী অবস্থানের কথাও জানিয়েছিলেন।
গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা দ্বিতীয় এবং (সরকার পরিচালনায়) তৃতীয় মেয়াদের সরকার গঠিত হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহিংসতার জন্য জামায়াতকে অভিযুক্ত করে। তবে ৫জানুয়ারি নির্বাচনের সাড়ে ছয় মাসের মাথায় গত বুধবার খালেদা জিয়ার ইফতার অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিও মজিনা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর কূটনীতিকরা যোগদেন।
এ সময় ইফতার অনুষ্ঠানে জামায়াত নেতাদের সাথে দেখা গেলে ঢাকায় কূটনীতিক কোরের ডিন শাহের মুহাম্মদ, সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ বিন নাসের আল বুশাইরি, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত হোসাইন মুফতুগু, মিশরের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইজ্জত, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত মেরিডি ল্যানডিমো, ব্রিটেনের ডেপুটি হাইকমিশনার নিকলো, অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার লুসিন্দা বেল, কাতারের ডেপুটি হেড অব মিশন খালিদ জাহিদ এম আল-মাহমুদ, কানাডার ডেপুটি চিফ অব মিশন ডেনিয়েল লুতফি প্রমুখ। এছাড়াও ইফতার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, ওমান, লিবিয়া, রাশিয়া, ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশের কূটনীতিকরাও।
কূটনীতিকদের পাশে পেয়ে ইফতার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান বললেন, “দলটির নেতারা নোংরা রাজনীতির শিকার। দলের আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সরকার অন্যায়ভাবে বন্দি করে রেখেছে।”
তিনি বলেন, “এর জন্য আমাদের অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আজকে রমজানের ইফতার মাহফিলে আমরা তাদের (জামায়াত নেতা) সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি।”
জামায়াতের নায়েবে আমির যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কূটনীতিকদের বলেন, “আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি ও মানবাধিকার লংঘন করে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে আমাদের সম্মানিত নিরপরাধ নেতৃবৃন্দের বিচার করা হচ্ছে।”
অপরদিকে জামায়াতকে দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামি দল দাবি করে মুজিবুর রহমান বলেন, “জামায়াত আন্তরিকভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। একটি শান্তিকামী রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত কখনো সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাস করে না। বরং সর্বপ্রকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করে।”
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, “জামায়াত বুঝতে পারছে আজকে পৃথিবীতে জঙ্গিবাদের রাজনীতি অচল। এ জন্য তারা এখন প্রায় আপনাদের ত্যাগ করতে শুরু করেছে।”
এ বিষয়ে কলামিস্ট ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, “যারা মৌলবাদি দল নয়, যারা গণতান্ত্রিক দল আজ সেই গণতান্ত্রিক দলগুলোও ধর্মকে ব্যবহার করছে।”
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে নূহ-উল-আলম লেলিন বলেন, “ইফতার পার্টি এখন সামাজিক অনুষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্রের কেউ বা কোনো রাজনৈতিক দল মিলনমেলার মত ইফতার পার্টি করতেই পারে। কিন্তু প্লাটফর্মটিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা-পক্ষে কী বিপক্ষে তখন রমজানের উদ্দেশ্যের সাথে ইফতার পার্টির উদ্দেশ্য মেলে না।”
তিনি বলেন, “ইফতার পার্টিতে যে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া হয়, তা ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যারাই এই ইফতার পার্টিকে ব্যবহার করুক না কেন তারা প্রকৃতপক্ষে রমজানের তাৎপর্যকে খাটো করছে।”
সূত্রমতে, জামায়াতে ইসলামী ইফতারের নামে বিদেশি কূটনৈতিকদের কাছে নালিশ করেছে। সারা দেশে কী হচ্ছে সেসব ভিডিও তারা বিদেশি কূটনৈতিকদের হাতে তুলে দিয়েছে। এটা কতটা যৌক্তিক। তারচেয়ে বড় কথা হলো ইফতারের নামে জামায়াতের এই কৌশল কতটা ইসলাম সম্মত।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বাহাউদ্দিন বলেন, “ইসলাম হচ্ছে শান্তিময়, উদার ও মানবতাবাদী ধর্মের নাম, জীবন ব্যবস্থার নাম। এর যে জীবন আচার এর যে জীবন পদ্ধতি সব কিছুই মানব উপযোগী এবং মানানসই। ইসলামের এই জীবন আচার ও পদ্ধতির অনিবার্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা বা রোজা। ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে রোজা একটি হলো সিয়াম সাধনা। এই মাসটির গুরুত্বের কারণ হলো এই মাসে মানবজাতির মুক্তির জন্য মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন।”