পুলিশের বিরুদ্ধে বহুকাল ধরেই বহু ধরনের অভিযোগ। তবে সম্প্রতি রাজধানীসহ সারা দেশে হত্যা, চাঁদাবাজি, চোরাকারবারিদের কাছ থেকে স্বর্ণ উদ্ধারের পর তা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। টাকা চেয়ে না পাওয়ায় ব্যবসায়ীদের চোখ বেঁধে পায়ে গুলি করার অভিযোগও উঠেছে।
এর বাইরে গ্রেপ্তার ও আটক বাণিজ্য এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা বা ক্রসফায়ার তো আছেই। এখন র্যাবের ক্রসফায়ারের খবর আর পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রসফায়ারের সব খবরই এখন পুলিশের। শুধু তাই নয়, পুলিশের বিরুদ্ধে কন্ট্রাক্ট কিলিংয়েরও (চুক্তিভিত্তিক হত্যা) অভিযোগ উঠছে।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর থানার এসআই জাহিদুর রহমানের হাতে ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজন খুন, বরিশালের গৌরনদীতে দাবিকৃত ১ লাখ টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রবাসীর ছেলে কম্পিউটার ব্যবসায়ী শাহীন মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা, ১ হাজার টাকার জন্য আশুলিয়ার নবীনগরে চা-বিক্রেতা রিপন হত্যাসহ নানা ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা যায়, সুজন হত্যা মামলাটি তদন্ত করছে ডিবি এবং শাহীন মোল্লা হত্যা মামলাটি তদন্তের জন্য আদালত র্যাবকে নির্দেশ দিয়েছেন।
সূত্রমতে, রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব পুলিশ সদস্যের প্রাইজ পোস্টিং দেওয়া হয়েছে, তারাই অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী হওয়ায় পদস্থ কর্মকর্তাদেরও ধার ধারছেন না। এভাবে পুলিশের নানা অপকর্ম বেরিয়ে আসায় তাদের মধ্যকার চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত এ সংস্থা একের পর এক রোমহর্ষক ও বিতর্কিত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। জানমাল রক্ষকের পরিবর্তে পুলিশ ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি যেমন নষ্ট হয়, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশি আতঙ্কও সৃষ্টি হয়েছে।
কিছু পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা, গুম, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে গোটা পুলিশ প্রশাসনকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জে সাত খুন ঘটনার পর র্যাব তাদের ক্রসফায়ার বন্ধ করলেও পুলিশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৮১ জন। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের সংখ্যাই বেশি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ষাণ্মানাসিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, পুলিশের সঙ্গে ৩৯, র্যাবের সঙ্গে ২৭ ও পুলিশ-র্যাবের সঙ্গে যৌথ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজন নিহত হন।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ মাসে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত প্রায় ১৭ হাজার অপরাধী সদস্য ও কর্মকর্তার সাজা হয়েছে। বিভাগীয় তদন্ত করে শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ নানা অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চাকরিচ্যুতি থেকে শুরু করে গুরুদণ্ড ও লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরও অনেকের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। তবে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অপরাধ করার পর বহু পুলিশ পার পেয়ে যাচ্ছে।
২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আরও শাস্তি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ ছাড়াও স্বর্ণলুট, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই ও প্রতারণাসহ নানা অপরাধে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (ডিবি ও র্যাব) গ্রেপ্তার করে আইনের হাতে সোপর্দ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৩ সালে পুলিশ কনস্টেবল থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত সাড়ে ১৩ হাজার সদস্য ও কর্মকর্তাকে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কাউকে তিরস্কার, কাউকে ভর্ৎসনাসহ নানা ধরনের বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সাত শর বেশি পুলিশ সদস্যকে। এর মধ্যে কারও প্রমোশন তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য স্থগিত। আবার একাধিক গুরুদণ্ড হলে চাকরিচ্যুতি ও পদাবনতিসহ বিভিন্ন ধরনের সাজা দেওয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মাসুদুর রহমান বলেন, “পুলিশের কোনো সদস্য ও কর্মকর্তা অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়াও কোনো কোনো অপরাধের জন্য ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কাউকে ছাড় দেওয়া হয়নি। অনেক পুলিশ জেলে আছে।”
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এস এম শাহজাহান বলেন, “দলীয়করণের কারণে বেশকিছু ঘটনা ঘটছে, যা পুলিশের কাছ থেকে কেউ আশা করে না।”