‘জমির মালিক হইতে পারব, এটা চিন্তাও করবার পারি নাই। ভুট্টা চাষই আমাগো বদলে দিছে।’ হাসিমুখে কথাগুলো বললেন কৃষক আবুজা মিয়া (৫০)। তিনি লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান ইউনিয়নের কৃষক।
সাত-আট বছর আগেও হতদরিদ্র এই মানুষটি ছিলেন দিনমজুর। একবার সাহস করে কিছু জমানো টাকা দিয়ে একখণ্ড জমি বর্গা নিয়ে ভুট্টা চাষ করেন তিনি। আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। গত তিন বছরে তিনি তিন একর জমি কিনেছেন। এ বছর তাঁর দুই একর জমিতে ২৮০ মণ করে ভুট্টা আবাদ হয়েছে। এতে খরচ হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা আর তিনি ভুট্টা বিক্রি করে আয় করেছেন দুই লাখ ২৪ হাজার টাকা। এক ছেলে এক মেয়েকে তাঁর। স্থানীয় একটি স্কুলে বড় মেয়ে দশম শ্রেণিতে, ছেলে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেিণতে।
ধু ধু বালুর চরের পতিত জমি নিয়ে যে এলাকার মানুষ ছিল দিশেহারা, সেখানে এখন পুরোদমে ভুট্টা চাষ হচ্ছে। গোটা এলাকার মানুষ ভুট্টা চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছে। অনেক ভূমিহীন কৃষক হয়েছেন জমির মালিক। এ চিত্র লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান ইউনিয়নের। মঙ্গাকে দূরে ঠেলে দিয়ে ওই এলাকার মানুষ এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। এক মৌসুমেই সেখানে কোটি কোটি টাকার ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে।
যেভাবে শুরু: সানিয়াজান এলাকার বেশ কয়েকজন প্রবীণ কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দশক আগে তিস্তা নদী গতিপথ বদলের কারণে এই এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকায় চর জাগে। চরের ধু ধু বালুতে কোনো আবাদ হতো না।
প্রবীণ কৃষক আবদুল লতিফ তালুকদার (৬০) জানান, অনেক দিন বেশির ভাগ জমি অনাবাদি থাকায় এলাকার মানুষ ছিল হতদরিদ্র। অনাবাদি বলে এখানের জমিও কেউ কিনতে চাইত না। এ অবস্থায় ১৯৯২ সালের দিকে তিনিসহ আরও কয়েকজন কৃষক এসব জমির মাটি পরীক্ষার জন্য গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশনের কাছে যান । শেষমেশ এসব জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে ভুট্টা চাষ করা হয়। প্রথম চাষের ফলন ভালো না হলেও তাঁরা আশায় বুক বাঁধেন, যে এই জমিতেও চাষ সম্ভব।
এরপর ওই এলাকার কৃষকেরা সংগঠিত হয়ে ১৯৯৭ সালে শেখ সুন্দর কৃষক সমিতি গঠন করেন। লতিফ তালুকদার ওই সময় সমিতির সভাপতি ছিলেন। তিনি জানান, সমিতি ওই সময় কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ নেয়। এরপর পুরোদমে ভুট্টা চাষ শুরু করেন তাঁরা। প্রথম বছরে এক একর জমিতে ১০-১২ মণ ভুট্টা চাষ হয়। সেই জমিতেই পরের বছর ৪০-৫০ মণ ভুট্টা চাষ হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে ভুট্টার ফলন। বর্তমানে এই এলাকায় প্রতি একরে ১৩৫ থেকে ১৪০ মণ ভুট্টা চাষ হয়। এখন শতভাগ জমিতেই ভুট্টার চাষ হচ্ছে।
হাতীবান্ধা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, হাতীবান্ধা উপজেলায় ভুট্টা চাষের বিপ্লব শুরু হয় সানিয়াজান এলাকা থেকে। গত বছর এই ইউনিয়নে ৬০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়। এই বছর সেখানে আবাদ হয় ৯০০ হেক্টর জমি। কৃষি কর্মকর্তা জানান, এই এলাকায় প্রতি হেক্টরে ৭ দশমিক ৭৫ টন ভুট্টা আবাদ হয়। সেই অনুপাতে ৯০০ হেট্টর জমিতে ছয় হাজার ৯৭৫ টন ভুট্টা আবাদ হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে গত বছর সারা দেশে ২২ লাখ টন ভুট্টা আবাদ হয়েছে। এই হিসাব অনুসারে সানিয়াজান ইউনিয়নে সারা দেশের শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য ৩৭১ শতাংশ।
উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে এই উপজেলায় ২০১১ সালে আট হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে, ২০১২ সালে আট হাজার ৫০০ একর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। চলতি রবি মৌসুমে নয় হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে।
বদলে গেছে জীবনধারা: সম্প্রতি সানিয়াজান এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বাজারে বড় বড় দোকানপাট। বেশির ভাগ বাড়িঘরই টিনের ছাদের দালান করা বাড়ি। বাড়ি বাড়ি মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। এখানের প্রত্যন্ত গ্রামেও স্যাটেলাইটসংযোগ। অথচ এক দশক আগেও অভাবী ছিল এই এলাকার মানুষ।
সানিয়াজানের কৃষক হাসেন আলী (৬০) আগে ঘর বানানোর মৌসুমে মানুষের ঘর বানিয়ে দিতেন। এখন তাঁর নিজের পাকা ঘর বানিয়ে দিচ্ছেন অন্যরা। বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের লাইন নিয়েছেন আগেই। গত সাত বছরে তিনি ভুট্টা চাষ করে দেড় একর জমি কিনেছেন। এই জমিতে এ বছর ৩০-৩২ হাজার টাকা খরচ করে ১৫০ মণ ভুট্টা আবাদ করেছেন। এটি তিনি বিক্রি করেছেন এক লাখ ৩০ হাজার টাকায়। কয়েক বছরের ভুট্টা চাষের লাভের টাকা দিয়ে চার মেয়ে এক ছেলের বিয়েও দিয়ে ফেলেছেন তিনি। এই ইউনিয়নের ফরহাদ হোসেন (৫০)। পাঁচ ছেলেমেয়ে তাঁর। ভুট্টা চাষ করে তিনিও বদলেছেন ভাগ্যের চাকা। সব ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা করিয়েছেন তিনি। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা এখন চাকরি করছেন। ছোট ছেলে দেলোয়ার হোসেন পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষে।
দেলোয়ার জানালেন, ‘ভুট্টা চাষ করে আমাদের সচ্ছলতা এসেছে। একটি এলাকা কীভাবে বদলে গেছে তা দেখতে হলে একবারের জন্য আমাদের ইউনিয়নে আসতে হবে।
উপজেলা সূত্র জানায় এই এলাকায় মোট ভোটার আট হাজার। এর মধ্যে অর্ধেক রয়েছেন নারী ভোটার। তবে এলাকার মোট জনসংখ্যা ১৬ হাজার বলে জানালেন এই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এনায়েত তালুকদার।
ভুট্টা বিক্রি করে কোটি টাকা: ভুট্টা চাষ করে শুধু সানিয়াজান এলাকায় এক মৌসুমেই কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়। ভুট্টা কিনতে ইতিমধ্যে এই এলাকায় গত কয়েক বছরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান জমিভাড়া নিয়ে বড় বড় দালানের গুদামঘর তৈরি করেছে। ফসল বিক্রি হওয়ার মৌসুমে গোটা এলাকা জমজমাট থাকে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, চলতি বছরের রবি মৌসুমে এই এলাকায় তিন হাজার ৮৭ একর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। প্রতি একরে ১৩৫ থেকে ১৪০ মণ ভুট্টার আবাদ হয়েছে। কৃষকেরা প্রতি মণ ভুট্টা ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন। সেই হিসাব অনুসারে এ বছরে এই এলাকার কৃষকেরা প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ভুট্টা বিক্রি করেছেন।
সানিয়াজানের স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুস সবুর জানান, এই এলাকায় ভুট্টা চাষ বেশি হওয়ার কারণে শ্রমিকেরা সারা বছর নানা কাজ করতে পারছেন। শ্রমিকেরা আলাদা আলাদা করে ভুট্টার খেত প্রস্তুত, নিড়ানি, সেচ দেওয়াসহ এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ করেন। এ ছাড়া ভুট্টা বড় হলে তা খেত থেকে সংগ্রহ, মাড়াই, বাছাই, শুকানোসহ নানা কাজে সারা বছরজুড়ে এই এলাকার শ্রমিকেরা ব্যস্ত থাকেন। ভুট্টা থেকে আলাদা করা মোচা ও ভুট্টার গাছ শ্রমিকেরা জ্বালািন হিসেবে ব্যবহার করেন।
শ্রমের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গত কয়েক বছরে এই এলাকায় নারীরাও ব্যাপক আকারে এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। নারীশ্রমিকদের একজন বুলবুলি বেগম জানালেন দৈনিক সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করেন তিনি। ছোট দুই ছেলেমেয়েকে তিনি স্কুলেও পাঠাচ্ছেন। ইউনিয়নের চেয়্যারম্যান এনায়েত উল্লাহ জানান, পাঁচ বছর আগেও এই গ্রামের মানুষ শিশুদের স্কুলে পাঠানোর থেকে কাজে লাগিয়ে দেওয়াকেই বেশি প্রাধান্য দিত। কিন্তু এখন শতভাগ শিশু স্কুলে যাচ্ছে। গ্রামের অনেকে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।
ভুট্টার আবাদে তামাক চাষ কমেছে: হাতীবান্ধা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভুট্টা চাষের ধারাবাহিকতার কারণে এই এলাকায় তামাক চাষ কমছে। অনেক তামাকনির্ভর কৃষক এখন ভুট্টা চাষ করছেন। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, তামাক একটি ঝুঁকিপূর্ণ ফসল, ফলনে ব্যয় বেশি। ঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ভুট্টা অনেক সহনশীল এবং ঝুঁকি কম। আর পরিবেশের জন্য তামাকের ক্ষতিকর দিক জেনে তারা এখন ভুট্টা আবাদে আগ্রহী বেশি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় জানায়, পাঁচ বছর আগেও চার থেকে পাঁচ হাজার হেক্টরে তামাক চাষ হতো। এখন গোটা উপজেলাতে ৭০০-৮০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। তবে তামাক চাষে কৃষকেরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
অনাবাদি পতিত জমিতে ভুট্টা চাষের কারণে এসব জমি এখন আগের থেকে অনেক বেশি উর্বর। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, সানিয়াজান এলাকার জমিগুলোতে এখন ভুট্টার আবাদের পর রোপা আমন ধান, পেঁয়াজ, মরিচ, গম আবাদ হয়।
দেশে একাধিক জেলার কারখানায় পোল্ট্রির খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নোরিশ পোল্ট্রির এবং হ্যাচারি লিমিটেডের পরিচালক এস এম সালাউদ্দিন প্রতিবছরে সানিয়াজান এলাকার ভুট্টা কেনেন। তিনি জানান, এই এলাকার ভুট্টার মান অনেক ভালো। দানা বড় হওয়ার কারণে ভুট্টা থেকে বিভিন্ন পোল্ট্রির খাবারও উন্নত মানের হয়।