মাত্র ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ২০০৫ সালে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তানিয়া ওয়াহাব। আজকে তাঁর সেই ব্যবসায়ের বার্ষিক লেনদেন এক কোটি টাকার ওপরে।রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় চামড়াশিল্প নিয়ে কাজ করা একমাত্র নারী উদ্যোক্তা তিনি।পরিচালনা করছেন দুটি প্রতিষ্ঠান
‘অন্যের অধীনে চাকরি করব না। অন্যদের চাকরি দেব৷ তাই ব্যবসা করি।আর ব্যবসা মানেই প্রতিযোগিতা। তবে আমরা দশে মিলেমিশে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা করছি।’
এমনটাই বলছিলেন কারিগরের ব্যবস্থাপনা অংশীদার এবং লেদার কেইভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তানিয়া ওয়াহাব। তিনি কাজ করছেন চামড়া নিয়ে। মেয়েদের জুতা, ব্যাগ, চামড়ার ফাইল, চাবির রিংসহ বানাচ্ছেন বিভিন্ন জিনিস। তাঁর তৈরি জিনিসপত্র যাচ্ছে কাতার, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশেও। দেশি ফ্যাশন হাউসের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বা বিভিন্ন সম্মেলন উপলক্ষে ‘গিফট আইটেম’ বানাচ্ছেন তানিয়া।
লেদার কেইভের যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালে। এটি একটি অংশীদারিমূলক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ১০টি প্রতিষ্ঠান মিলে একত্রে কাজ করছে। কারিগরে যে ধরনের পণ্য তৈরি হচ্ছে, এখানেও মূলত সে ধরনের পণ্যই তৈরি হচ্ছে। তবে নিজেদের ব্র্যান্ড হিসেবে লেদার কেইভ সরাসরি বাজারে পণ্য বিক্রি করছে।
তানিয়ার সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর হাজারীবাগে তাঁর কারিগর ও লেদার কেইভের কারখানায়। ব্যবসায়িক কাজের ফাঁকে জানালেন ব্যবসায়ী হওয়ার ইতিবৃত্ত।
তানিয়ার বাবা মারা যান ২০০২ সালে। তানিয়ার দাদা-বাবা কেউই কখনো ব্যবসা করেননি। সেই পরিবারের মেয়ে ব্যবসা করবেন, তা কেউ মেনে নিতে পারেননি। ব্যবসা করার জন্য কোনো দিকনির্দেশনাও পাননি তানিয়া। ২০০৫ সাল থেকে ব্যবসা শুরু করা তানিয়া ব্যবসায়িক মহলে এখন পরিচিত একটি নাম। গত বছর পেয়েছেন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-ডিএইচএলের ‘আউটস্ট্যান্ডিং উইমেন ইন বিজনেস’ শীর্ষক অ্যাওয়ার্ড। এর আগেও শিল্প মন্ত্রণালয়ের জাতীয় এসএমই নারী উদ্যোক্তা পুরস্কারসহ পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার।
বাংলাদেশ কলেজ অব লেদার টেকনোলজি থেকে বিএসসি করেন তানিয়া। এই ইনস্টিটিউটে ভর্তির আগেও তেমন কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তাঁর। তবে পড়ার সময়ই চামড়া নিয়ে কিছু করার চিন্তা মাথায় আসে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে এমএ করছেন। পড়াশোনার ফাঁকেই চলছে ব্যবসা। বিয়ে, সংসারও থেমে নেই। একসময়কার সহপাঠীকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন তানিয়া। তবে স্বামী ব্যবসায় নিজেকে জড়াননি। স্ত্রীর ব্যবসায় কখনো বাধাও দেননি।
মাত্র ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ২০০৫ সালে ব্যবসা (কারিগর) শুরু করেছিলেন তানিয়া। তারপর এই ১০ হাজার টাকার সঙ্গে ক্রমেই কিছু পুঁজি যোগ করতে হয়েছে। একটি বড় কোম্পানির পক্ষ হয়ে মাত্র ছয়টি ডায়েরি তৈরি দিয়ে শুরু। এর পর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হয়েই কাজ করে আসছিলেন। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে শুরু করেন সরাসরি অর্ডার নিয়ে কাজ। বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানি, ব্যাংক, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে কাজ হচ্ছে।
তানিয়া ওয়াহাব প্রথম আলোকে জানান, ‘১০ হাজার টাকা নিয়ে যে ব্যবসা শুরু করেছিলাম, সেই কারিগরের এখন বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ এক কোটি ২০ লাখ টাকা।’
কারিগরে নিয়মিত শ্রমিক আছেন ২০ জন। আর অনিয়মিত শ্রমিক ১০০ জন। নিয়মিত শ্রমিকের মজুরি সাড়ে তিন হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। অনিয়মিত শ্রমিকেরা কাজ করেন পিসরেট হিসেবে (পণ্য উৎপাদনভিত্তিক মজুরি। যতটি পণ্য উৎপাদন করবেন, সে অনুযায়ী মজুরি পাবেন)।
দশে মিলে করি কাজ: তানিয়া ব্যবসা করছেন একটু ভিন্ন ধাঁচে। তাঁর ব্যবসার মূলমন্ত্রই হচ্ছে দশে মিলে করি কাজ। তানিয়া বলেন, ‘আমরা লেদার টেকনোলজিস্ট স্মল এন্ট্রাপ্রিনিউরস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামে একটি সমিতি গড়ে তুলেছি। লেদার টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেছেন, ব্যবসা করতে চাইছেন, তাঁদের নিয়েই এ সমিতি। শুরু হয় সাতজন সদস্য নিয়ে। আমরা সবাই প্রতিযোগী। তার পরও একে অন্যকে সাহায্য করব, সে উদ্দেশ্য নিয়েই সমিতির যাত্রা শুরু। একসঙ্গে মালপত্র কেনা, একজন বড় একটি কাজ পেয়েছে, কিন্তু শ্রমিক নেই, তাঁকে শ্রমিক দিয়ে সহায়তা করা, বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে। এখন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ২২। আরও নতুন ১১ জনের সদস্যপদ প্রক্রিয়াধীন আছে।’
তানিয়া এ সমিতির যুগ্ম সম্পাদক। এর সদস্যরা মূলত তরুণ। ২৬ থেকে শুরু করে ৪০ বা ৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তিরাই এখন পর্যন্ত সদস্য। আর সদস্যদের মধ্যে একমাত্র নারী সদস্য তানিয়া।
সমিতির সম্পাদক হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগরের হাজারীবাগ এলাকায় চামড়া নিয়ে কাজ করা একমাত্র নারী উদ্যোক্তা তানিয়া।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সমিতির জন্য ‘কমন ফ্যাসিলিটিস সেন্টার’ তৈরির অংশ হিসেবে কিছু সরঞ্জাম পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগ্রহী নতুন উদ্যোক্তারা এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। এ ছাড়া সমিতি একটি তহবিলও গঠন করতে যাচ্ছে। এ তহবিল থেকে সমিতির সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হবে। তাঁরা দেশে ফিরে অন্যদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এতে খরচ অনেক কমে যাবে।
ব্যবসার ক্ষেত্রে ভাড়া বাড়িকে একটি বড় সমস্যা মনে করেন তানিয়া। তাঁর মতে, শুধু এই সমস্যার কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মধ্যম বা বড় ব্যবসায়ী হতে পারছেন না। পছন্দ অনুযায়ী ফ্লোর ভাড়া পাওয়ার পর কাজকর্ম গুছিয়ে বসতে না বসতেই বাড়ির মালিক যদি চলে যেতে বলেন, চলে যেতে হয়। আগুন থেকে বাঁচার জন্য যেসব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, তা চাইলেও করা সম্ভব হয় না। বিকল্প সিঁড়ি তৈরিরও অনুমতি মেলে না। সমিতির পক্ষ থেকে সাভারে জায়গা দেখা হয়েছে। জমি কেনার পর সেখানে একটি ভবনে ব্যবসা শুরু করার স্বপ্ন দেখছেন সমিতির সদস্যরা।