
ঢাকা: ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে মালয়েশীয় উড়োজাহাজের ভূপাতিত হওয়ার স্থানে প্রবেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের পুরোপুরি সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছে ইউরোপের নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থা (ওএসসিই)। একইসঙ্গে ৩০ সদস্যের ওই প্রতিনিধি দলকে ‘স্থানীয় অবৈধ সশস্ত্র গোষ্ঠী’গুলো পরিদর্শন কাজে বাধা দিচ্ছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
শুক্রবার রাতে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেছেন আন্তর্জাতিক তদন্তকারী দলের প্রতিনিধিরা। ৩০ সদেস্যর প্রতিনিধি দলটি হেলিকপ্টারযোগে রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তবর্তী দোনেৎস্ক শহরের গ্রাবোভো গ্রামে পৌঁছে পরিদর্শন কাজও শুরু করে।
এলাকাটি রুশপন্থি বিদ্রোহীদের দখলে রয়েছে। উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুমতি দেয় সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।
কিন্তু প্রতিনিধি দলের ঘটনাস্থল পরিদর্শন কার্যক্রম কিছুক্ষণের মধ্যেই ওএসসিই’তে নিযুক্ত সুইস অ্যাম্বাসেডর থমাস গ্রেমিঙ্গার জানান, প্রতিনিধিদের ঘটনাস্থলে প্রবেশে পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয় কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী তাদের পরিদর্শন কাজ থামিয়ে দিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় দুপুরের কিছু আগে দোনেস্কের গ্রাবোভো গ্রামের একটি সূর্যমুখী ফুলের মাঠে ১৫ ক্রুসহ ২৯৮ আরোহীবাহী উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। তবে, এটিকে বিধ্বস্ত না বলে ভূপাতিত বলছে মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা।
এদিকে, প্রতিনিধি দলের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও এ ঘটনায় জরুরি বৈঠকে বসেছে বলে জানিয়েছে সংবাদ মাধ্যমগুলো। বলা হচ্ছে, ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে উড়োজাহাজটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে।
নিরপাত্তা পরিষদ অবশ্য বৈঠকের আগে এক বিবৃতিতে এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে। একইসঙ্গে এ ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জ্ঞাপন করে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ এ নীতি নির্ধারক পরিষদ।
উড়োজাহাজটি ভূপাতিত হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শুক্রবার হোয়াইট হাউজে বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে জানান, ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে থাকা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্ক শহরে উড়োজাহাজটি ভূপাতিত করা হয়েছে।
ওই অঞ্চলে দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠাসহ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন ওবামা।
মাত্র চার মাসের মধ্যে এটি মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের দ্বিতীয় মহাবিপর্যয়। গত মার্চেই ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে নিখোঁজ হয় এই এয়ারলাইন্সের এমএইচ৩৭০ নং ফ্লাইটটি। সে রহস্যের কূলকিনারা এখনও হয়নি।
উড়োজাহাজ ভূপাতিত হওয়ার জের ধরে পেন্টাগন-ক্রেমলিন সম্পর্কে আরও তিক্ততা ছড়াতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সম্ভবত স্নায়ুযুদ্ধের পর সিরিয়া ইস্যুকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে রাশিয়ার মদতপুষ্ট ইউক্রেনিয়ান বিচ্ছিন্নতাবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলে এ মহাবিপর্যয়ের ঘটনা।
জাতিসংঘ ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের তদন্ত দাবির পাশাপাশি এ ব্যাপারে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিশ্ব নেতারাও।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেন, উড়োজাহাজটি ভূপাতিত হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক ইঙ্গিত রয়েছে। আমাদের সেগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও ঘটনার ‘পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিরপেক্ষ’ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো এ ঘটনাকে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ আখ্যায়িত করে বলেন, এটি পুরো বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সব সীমা অতিক্রম করে গেছে।
নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টার্ডাম থেকে কুয়ালালামপুরগামী মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজটি বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক সময় ১৪টা ১৫ মিনিটে ইউক্রেনের শাখতেরেস্ক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। রুশ সীমান্ত থেকে স্থানটির দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার।
উড়োজাহাজটিতে থাকা ২৯৮ যাত্রীর মধ্যে সর্বশেষ প্রতিবেদন মতে, উড়োজাহাজটিতে ১৮৯ জন ডাচ, ২৭ জন অস্ট্রেলিয়ান, ৪৪ জন মালয়েশিয়ান, ১২ জন ইন্দোনেশিয়ান ও নয় জন ব্রিটিশ, চার জন জার্মান নাগরিক ছিলেন। এদের মধ্যে ৮০ জনই শিশু ছিল।
সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, মাটি থেকে ছোঁড়া উড়োজাহাজ বিধ্বংসী ‘বিইউকে’ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত হয়েছে উড়োজাহাজটি। তবে ইউক্রেন সহ পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলোর ধারণা, প্লেন থেকে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রেও বিধ্বস্ত হতে পারে উড়োজাহাজটি।
সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ইউক্রেন থেকে রাশিয়ায় প্রবেশের প্রাক্কালে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ হাজার মিটার উচ্চতায় উড়োজাহাজটিতে আঘাত হানে ক্ষেপণাস্ত্র।
পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, যে স্থানে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে সেখানে আগে থেকেই ইউক্রেনের রুশপন্থি বিদ্রোহীদের তৎপরতা চলছে। সোমবার ওই এলাকায় একইভাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে একটি ইউক্রেনীয় পরিবহন উড়োজাহাজ ভূপাতিত করে বিদ্রোহীরা। এছাড়া বৃহস্পতিবারও ইউক্রেনের একটি যুদ্ধবিমানকে একইভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ভূপাতিত করে রুশ জঙ্গিবিমান।
মালয়েশীয় এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটি আমস্টার্ডাম থেকে আন্তর্জাতিক সময় বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ১৪ মিনিটে উড়াল দেয়। মালয়েশিয়া সময় পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার ভোর ৬টা ৯ মিনিটে এটি কুয়ালালামপুরে পৌঁছার কথা ছিলো।
এ ঘটনার পর বিবৃতিতে মালয়েশিয়ান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক তাৎক্ষণিকভাবে জানান, তিনি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার খবরে ‘স্তম্ভিত’।
এরপর সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, এ কথা নিশ্চিত উড়োজাহাজটিকে ভূপাতিত করা হয়েছে, এখন এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করাই মালয়েশীয় সরকারের প্রধান কাজ।