মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় এমভি পিনাক-৬ নামক লঞ্চ আজ সোমবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ডুবে যাওয়ার ঘটনায় আরও ২ লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়ে উদ্ধার হওয়া লাশের সংখ্যা ৪। আজ মঙ্গলবার দুপুরে চাঁদপুরের হাইমচর এলাকায় ২টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ওই দুই লাশ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এ ছাড়াও এ দুর্ঘটনায় আরও শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে।জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, নিখোঁজদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের তালিকায় ১২০ জন নিখোঁজ রয়েছে। মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত মোট ৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সকালে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম এবং নির্ভীক দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও লঞ্চটি শনাক্ত করা যায়নি।
‘ওদের বাঁচাও, ওরা আমার বুকের মানিক, আমি যাই‘
ওরা আমার মানিক জোড়। ওরা আমার বুকের মানিক। ওদের বাঁচাও। ডুবে যাওয়ার আগ মুহূর্তে স্বামীর উদ্দেশ্যে শেষ আর্তি করেন দুই সন্তানের মা শেফালি (৩৪)। স্ত্রী, দুই সন্তানকে হারিয়ে ফরিদপুরের শালথা উপজেলার গোট্রি গ্রামের সৈয়দ মুহাম্মদ সাদী (৪৫) পদ্মাপাড়ে বিলাপ করে স্ত্রীর শেষ কথাগুলি বলে বলে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন।সাদী বলেন, লঞ্চটি যখন ডুবে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে আমি আমার কলিজার টুকরা আরাফ (৮) এবং এনামকে (৪) বুকে জড়িয়ে বলি, তোমরা দুই ভাইবোন আমার দুই হাত ধরে রাখো। বাচ্চার মাকে বলি, শেফালি তুমি আমার মাজার বেল্ট ধরে রাখো। আমি একাই তোমাদের নিয়ে সাঁতরিয়ে তীরে উঠবো। আমার কথা শুনে আমার ছেলেরা ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি তাদের দু’জনকে দুই হাতে ধরে পদ্মায় ঝাঁপ দেই। শেফালি আমার মাজার বেল্ট ধরে রাখে। কিছুটা যেতেই শেফালি আমাকে বলে, ওদের বাঁচাও, আমি চলে যাই। আমি বলেছিলাম আমাকে শক্ত করে ধরো। কিন্তু শেফালি আর তা পারেনি। অমার মাজার বেল্ট ছিঁড়ে সে হারিয়ে যায় স্রোতের তোড়ে। কিছুদূর যেতেই ওরা আমার হাত থেকে ছুটে যায়। এরপর আমি আর তাদের খুঁজে পাচ্ছি না। আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কি। আমার সংসারে আর কেউ নেই।
তিন সন্তান হারিয়ে মা হাসির মুখে কান্না
বুকের ধন ৩টি সন্তানকে হারিয়ে মা হাসি এখন কান্নায় ডুবে আছেন। দুর্ঘটনায় কবলিত লঞ্চটিতে পানি উঠতে দেখে বোনের ছেলে সুজনকে (২০) জুতা খুলতে বলে নিজের সন্তান রিপা (১৪), মিরাজ (৯) ও ১৮ মাসের পুত্র ইব্রাহিমকে কোলে তুলে নিয়ে নিচ তলা থেকে উপর তলায় উঠে আসেন হাসি বেগম। মুহূর্তের মধ্যে লঞ্চটি ডুবে গেলে তার দু’সন্তান রিপা ও মিরাজ পানির স্রোতে ভেসে যায়। উদ্ধারকারীরা তাকে টেনে তোলার পূর্ব মুহূর্তে কোল থেকে ছুটে যায় শিশুপুত্র ইব্রাহিম। আজ মঙ্গলবার দুপুরে স্বামী রহিম মাদবরকে দেখা যায় স্ত্রী হাসি বেগমকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাদঁছেন। তাদের কান্নায় মাওয়ার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। রহিম মাদবর জানান, তাদের বাড়ি শিবচর উপজেলার করুপচর গ্রামে। তিনি ঢাকার গুলশান নতুন বাজার এলাকায় একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকুরি করেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে সেখানেই থাকেন। ঈদ উপলক্ষে সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি বৃহস্পতিবার কর্মস্থলে চলে যান। ভায়রার ছেলে সুজনকে দায়িত্ব দেন তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার। গতকাল সোমবার সকালে লঞ্চে উঠে হাসি বেগম তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এর একঘণ্টা পর একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন করে সুজন তাকে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানায়। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন না যে তার তিন সন্তান হারিয়ে গেছে।
একই পরিবারের ৭ জন নিখোঁজ
ফরিদপুরের সদরপুর এলাকার মহিলা মেম্বার রেখা জানান, তার বোন শিমুল, বোনের স্বামী রুবেল, মেয়ে ফারেজা আক্তার ও ফাতেহা, ভাই সোবহান, ভাবী ইতি আক্তার, ভাতিজি ইভা আক্তার দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটিতে ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের হাতেই মোবাইল ফোন ছিল। তার পরিবারের ওই ৭ জনের কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।
স্বজনদের ক্ষোভ
মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার ৩০ ঘণ্টা পার হলেও শনাক্তকরণ সম্ভব হয় নাই। এ কারণে মাওয়া ঘাটে অপেক্ষমান স্বজন হারা মানুষের মাঝে ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে। ইতোমধ্যে স্বজনরা দু’দফা ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। মাওয়া ঘাটের কাছে লঞ্চডুবির ঘটনায় স্বজনহারা বিক্ষুব্ধ লোকজন লঞ্চ উদ্ধার কার্যক্রমে গাফলতির অভিযোগে প্রথমে গভীররাতে মাওয়া চৌরাস্তার কাছে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক অবরোধ করে। বৃষ্টির কারণে তাদের অবরোধ কর্মসূচি থেমে গেলেও পুনরায় সকাল সাড়ে ৭টার দিকে আবারও বিক্ষুব্ধ স্বজনরা মহাসড়ক অবরোধ করে। এ সময় তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং সাংবাদিকদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে চড়াও হয়। এসময় মহাসড়কে প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ফেরিঘাট এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। এতে যাত্রীরা চরম বিপাকে পড়েন। কেউ কেউ দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে গন্তব্যে চলছেন। পরে পুলিশ, র্যাবের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়