ঢাকা: ঢাকা মহানগর বিএনপির নবনির্বাচিত আহবায়ক মির্জা আব্বাসের ‘অবহেলা’র জবাবে নতুন সদস্যসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের পাশে দাঁড়িয়েছেন সাবেক আহবায়ক সাদেক হোসেন খোকা।
সূত্র জানায়, সোহেলের ‘প্রয়োজনের মুহূর্তে’ আব্বাস-খোকা’র দ্বন্দ্ব এক প্রকার আশির্বাদ হয়েই দেখা দিয়েছে।
সূত্রের দাবি, ক্রমশই শক্তি বাড়ছে সোহেলের। নিজের অনুসারিদের আরও সংগঠিত করছেন তিনি। সঙ্গে বোনাস হিসেবে পাওয়া খোকার অনুসারিরাও পাশে থেকে সমর্থন দিচ্ছেন তাকে। কারণ খোকার ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ আব্বাসের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার ভালো সুযোগ পেয়েছেন বলে মনে করছেন তারা।
আর এই মর্মে দিকনির্দেশনা ও পরামর্শও নাকি দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে পাঠিয়েছেন স্বয়ং খোকাই।
যদিও খোকার ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি একটু অন্য রকম। তাদের ভাষ্য, বিষয়টি খোকার পক্ষ থেকে এসেছে বলে গুঞ্জন থাকলেও মূলত কর্মীরা নিজে থেকেই এই আচরণ করছেন। তারা সোহেলের নয়, শক্তি বাড়াচ্ছেন সংগঠনের।
সোহেল অবশ্য বলেন, দলের প্রয়োজনে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কে কার অনুসারি সেসব বিবেচনা করে নয়, আমরা সবাই জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ও গণতন্ত্রের স্বপক্ষ শক্তি হিসেবে কাজ করবো। এটাকেই মূলকথা ধরে শক্তি বাড়াচ্ছি আমরা।
তিনি বলেন, নেত্রী (বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া) আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তার যথোপযুক্ত সম্মান রাখতে যা করা সম্ভব সবই করবো আমি।
আব্বাসের ‘অবহেলা’র বিষয়টি জানতে চাইতেই তা এককথায় হেসেই উড়িয়ে দিলেন সোহেল: ‘ তিনি আমার বড় ভাই। আমরা দু’জনেই দলের পরীক্ষিত সৈনিক। দলের প্রয়োজনে আমরা কাজ করি। এখানে দ্বন্দ্বের কিছু নেই। তিনি আমাকে স্নেহ করবেন, আমি তাকে শ্রদ্ধা করি- এখানে আর কিছু বলার নেই।’
সোহেল ‘অন দ্য রেকর্ড’ এসব কথা বললেও বাস্তবতা কমবেশি জানেন সবাই। এই দুই নেতার ‘সম্পর্ক মোটেই ভালো নেই’ বলে সংশ্লিষ্টরা যেমন জানেন, তেমনি অন্যদেরও চোখে পড়েছে তা।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সোহেল কমিটি ঘোষণার পর থেকেই নানা রকম সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন।
আব্বাস যে সোহেলকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না, বরং অবহেলা করছেন সেই মর্মে পত্রিকাগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। খবরে আরও বলা হয়েছে, আব্বাস নাকি সদস্যসচিব হিসেবে নিজের পছন্দের কাউকে, নিজের ঘরানার কাউকে চেয়েছিলেন।
এ বিষয়ে আব্বাসের নিকটজনরা কিন্তু অবাক হয়েছেন। তারা বলছেন, আব্বাসের চেয়ে সোহেল অনেক জুনিয়র। তাই তার সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা থাকার প্রশ্নই আসে না। তবে এত গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আরও অভিজ্ঞ কাউকে চেয়েছিলেন আব্বাস। কারণ সদস্যসচিবের ব্যর্থতার দায়ও চাপবে আব্বাসের ঘাড়েই।
শুধু আব্বাস নন, সোহেলকে নাকি আবদুল আউয়াল মিন্টুসহ নতুন কমিটির আরও অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু সেসব বিষয় ‘অন দ্য রেকর্ড’ বলতে চাননি তারাও।
দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে অপ্রীতিকর ঘটনা, সংগঠনের কার্যালয়ে তালা কাহিনী- এসবই মিডিয়ায় এসে পড়ায় লোক জানাজানিও হয় অনেক বেশি।
পবিত্র ওমরাহ পালন শেষে খালেদা জিয়া যেদিন ফিরছিলেন সেদিনও এয়ারপোর্টে চোখে পড়ার মতো দূরত্ব রাখছিলেন এই দুই নেতা। সোহেল সেখানে আগে থেকেই ছিলেন। পরে যান আব্বাস।
সিনিয়র এই নেতাকে ছেঁকে ধরেন উপস্থিত সাংবাদিক ও মহিলাদলের নেতাকর্মীরা। তিনিও হাসিমুখে ক্যামেরার সামনে পোজ দিচ্ছিলেন।
কয়েকজন সাংবাদিক দুই নেতাকে একই ফ্রেমে বন্দী করতে চাইলেও এড়িয়ে যান তারা। বলা যায়, দুইজনেই না-শোনার ভান করেন।
সোহেল দূর থেকে আড়চোখে আব্বাসকে দেখছিলেন অভিমানী চোখে, কিন্তু আব্বাস তাকাচ্ছিলেন না আরও বেশি অভিমানী মুরব্বির মতো।
নানাদিনের নানা ঘটনায় সাংবাদিক ও অন্যদের প্রশ্নের জবাবে সোহেলকে মাঝে মাঝে অপ্রস্তুতও লক্ষ্য করা গেছে। তবে সহজে কারও কাছে এটি স্বীকার করেন না সাবেক এই ছাত্রনেতা।
‘সম্পর্কের অবনতির বিষয় জানাজানি হলে তার আরও অবনতি হয়’ বলে প্রচলিত রয়েছে। সেটিই ঘটেছে এই দু’জনের ক্ষেত্রেও।
অভিমানী সোহেল আব্বাসের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাওয়ার ভুল না করে নিজের শক্তি বাড়াতে থাকেন। আর পাশে পেয়ে যান খোকা-সমর্থকদের।
এর প্রমাণও মেলে ঈদের দিনে খালেদা জিয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে খালেদা ১১টায় উপস্থিত হতে পারলেন না। এলেন ঘন্টাখানেক দেরিতে। কিন্তু এই সময়টিতেই সেখানে হুলস্থুল বাঁধিয়ে ফেলেন তিন নেতার অনুসারিরা।
হলে ঢোকার পথে আব্বাসের অনুসারিরা বাধা দেন সোহেলের লোকজনকে। সোহেল সিনিয়র বড় ভাই আব্বাসের প্রতি সম্মান রেখে চুপচাপ থাকেন। আব্বাসও এই সময়টিতে ব্যস্ত ছিলেন অন্য নেতা ও অতিথিদের সঙ্গে আলাপচারিতায়।
ধাক্কাধাক্কি, বাকবিতণ্ডা চলে বেশ কিছুক্ষণ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন দলের অন্যান্য নেতা-কর্মী, সিএসএফ(চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স) সদস্যরা। কিন্তু বেগ পেতে হচ্ছিল তাদের।
এক সময় ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজে, খালেদা আসেন। পরিস্থিতিও তখনই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। খোকা-সোহেল মিতালির বিষয়টি সেদিনই মূলত সবার গোচরে আসে।
আব্বাসও ওয়াকিবহাল হন এ বিষয়ে। তবে এসব নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হন না বিএনপির স্থায়ী কমিটির বিচক্ষণ এই নেতা। খোকা প্রসঙ্গে তিনি বরাবরই বলেন, ‘খোকা আমার বন্ধু।’
এসব ঘটনার অনেকটাই খালেদার কাছে পৌঁছে দেন এই দুই নেতার শুভাকাঙ্ক্ষী ও প্রতিদ্বন্দ্বী নেতারা। কিন্তু সিদ্ধান্তে অটল খালেদা তেমন কোনো মন্তব্য করেন নি।
কেউ কেউ অনুমান করছেন, বিষয়টি যে এরকম হবে তা আগে থেকেই জানতেন খালেদা। কিন্তু এতে আন্দোলনের প্রস্তুতিতে কোনো রকম ক্ষতি হবে না বলেও বিএনপিপ্রধানের বিশ্বাস।
এরপর কেটে যায় আরও কিছু সময়। মহানগরের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন খালেদা। সেখানে নিয়ম অনুসারে আব্বাস ও সোহেল উপস্থিতও ছিলেন।
খালেদা স্পষ্টভাষায় তাদের বুঝিয়ে দেন নিজেদের সমস্যার চেয়ে দলের প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
সোহেলের ঘনিষ্ঠ এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের মধ্যম সারির এক নেতা বলেন, সোহেল সব কিছুই হজম করছে। কারণ ম্যাডাম(খালেদা জিয়া) তার প্রতি আস্থার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তুমি মাঠে পোড় খাওয়া নেতা। এখন দলের জন্য নিজের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দেখানোর সময় এসেছে। নিজের মতো করে গুছিয়ে কাজ কর।
এই নেতা আরও বলেন, ম্যাডামের সেই কথা মেনেই ধৈর্য্য ধরছেন সোহেল। তাছাড়া মির্জা আব্বাসের মতো নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বিতর্কিত হওয়ার মতো বোকা সোহেল নন। বরং সবার সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
সোহেলের আরেক ঘনিষ্ঠ অনুসারি বলেন, খোকার অনুসারিরা আমাদের সঙ্গে আছেন। আমাদের অবস্থান শক্ত আছে। সোহেলের কার্যকলাপে সন্তুষ্ট হয়ে আব্বাস এক সময় তাকে ঠিকই আপন করে নেবেন বলে বিশ্বাস করেন সোহেল।