বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই কব্জায় নিয়েছে রাজধানীর কোরবানির পশুর হাট। কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করেছে ১৯টি হাটের টেন্ডার। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা এরই মধ্যে খুন হয়েছেন। তবু ভাঙা যায়নি এই সিন্ডিকেট। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ১৯টি হাটের ইজারায় ১৭৩টি শিডিউল বিক্রি হলেও জমা পড়েছে ৬৩টি। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ১১৩টি শিডিউল জমা পড়েনি। একটি হাটের কোন শিডিউল জমা পড়েনি। এছাড়া বেশির ভাগ হাটেই ছিল ৩টি করে শিডিউল জমা। দুই সিটির দু’টি ছাড়া বাকি প্রায় সব ক’টিতেই দর পড়েছে বিগত তিন বছরের দরের চেয়ে কম। এ কারণে এ সব হাটের নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা হবে বলে উভয় সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়। তারা বলেন, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা ও সিন্ডিকেটের কারণেই মওসুমি এই হাটের দর এমন হয়েছে। শাসকদলীয় এই সিন্ডিকেট চক্র এতটাই প্রভাবশালী যে, এবার পশুর হাটের জন্য তাদের বাইরে অন্য কেউ তেমন সিডিউলই কিনতে পারেনি। আবার যারা নানা কৌশলে সিডিউল কিনেছেন তাদের বেশির ভাগই কেনা সিডিউল জমা দিতে পারেননি। সূত্র জানায়, উভয় সিটির প্রতিটি হাটের জন্য একাধিক দরপত্র বিক্রি হলেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা ও সিন্ডিকেটের প্রভাবে জমা পড়েছে গড়ে ৩টি হারে। এতে কাঙ্ক্ষিত দর পাচ্ছে না ডিসিসি। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ আহম্মেদ বলেন, দু’-একটি হাট ছাড়া বেশির ভাগ হাটের কাঙ্ক্ষিত দর পাওয়া যায়নি। কোন কোন আর হাটে গতবারের চার ভাগের এক ভাগ দামে দর পড়েছে। এগুলোর নিয়মানুযায়ী পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হবে। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাজধানীতে অস্থায়ী পশুর হাটের প্রধান নির্বাহী আহ্বায়ক করে একটি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। মূল্যায়ন কমিটি নির্ধারণ করবে ইজারার চূড়ান্ত বিষয়। দক্ষিণ সিটির দেয়া তথ্যানুযায়ী ১১টি হাটের মধ্যে হাজারীবাগ মাঠ পশুর হাটের জন্য সিডিউল বিক্রি হয়েছে ১৯টি, জমা পড়েছে একটি, রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ পশুর হাটের সিডিউল বিক্রি হয়েছে তিনটি, জমা পড়েছে তিনটি, খিলগাঁও মেরাদিয়া পশুর হাটের সিডিউল বিক্রি হয়েছে ১৩টি, জমা পড়েছে চারটি, গোলাপবাগ মাঠের পাশের সিটি করপোরেশনের আদর্শ স্কুল মাঠ ও আশপাশের খালি জায়গার অস্থায়ী পশুর হাটের সিডিউল বিক্রি হয়েছে নয়টি, জমা পড়েছে সাতটি, উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজার সংলগ্ন মৈত্রীসংঘের মাঠের জন্য বিক্রি হওয়া তিনটি সিডিউলই জমা পড়েছে, ধুপখোলার ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব মাঠের সিডিউল বিক্রি হয়েছে ১১টি, জমা পড়েছে তিনটি, কমলাপুর গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়ন সংলগ্ন বালুর মাঠের পশুর হাটের সিডিউল বিক্রি হয়েছে ছয়টি, জমা পড়েছে চারটি, পোস্তগোলা শ্মশানঘাট সংলগ্ন খালি জায়গার জন্য বিক্রি হওয়া চারটি সিডিউলই জমা পড়েছে, কামরাঙ্গীরচর ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়ির মোড় হতে দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধ সংলগ্ন জায়গার পশুর হাটের জন্য সিডিউল বিক্রি হয়েছে সাতটি, জমা পড়েছে তিনটি এবং লালবাগ মরহুম হাজী দেলোয়ার হোসেন খেলার মাঠ ও মাঠ সংলগ্ন বেড়ি বাঁধের খালি জায়গা এবং আশপাশের এলাকার পশুর হাটটির জন্য বিক্রি হওয়া তিন সিডিউলই জমা পড়েছে। জমা পড়া সিডিউলগুলোর মধ্যে হাজারীবাগ মাঠ পশুর হাটের জন্য যুবলীগের মো. মাসুদ রানা দর প্রস্তাব করেছেন ১১ লাখ ১১ হাজার ১০ টাকা। ২০১৩ সালে এই হাট ইজারা দেয়া হয় ৫৫ লাখ ৩৪ হাজার ২০ টাকায়। লালবাগ রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ পশুর হাটের জন্য জমা পড়া তিনটি সিডিউলের মধ্যে ইমতিয়াজ হামিদ সবুজ দর দিয়েছেন চার লাখ টাকা, রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি দর দিয়েছে ছয় লাখ ৬৩ হাজার ২৭৪ টাকা, এসএম মাহমুদ আলী দর দিয়েছেন দুই লাখ ২০ হাজার টাকা। মেরাদিয়া পশুর হাটের জন্য চার দরদাতার মধ্যে শামীম ভূঁইয়া সিডিউল ফরমে কোন দর উল্লেখ করেননি। অন্য দরদাতাদের মধ্যে সাবা এন্টারপ্রাইজ সর্বোচ্চ ৫৬ লাখ টাকা দর প্রস্তাব করেন। এই হাটের জন্য মো. শরীফ ৪০ লাখ ১০ হাজার টাকা, ইয়াকুব আলী ৪২ লাখ এক হাজার টাকা দর প্রস্তাব করেন। ২০১৩ সালে এই হাটে সর্বোচ্চ ২৬ লাখ এক হাজার টাকা দরে ইজারা দেয়া হয়। সাদেক হোসেন খোকা মাঠের বিপরীতে সিডিউল ৩৫টি বিক্রি হলেও জমা পড়েছে মাত্র চারটি। এই হাটের জন্য সর্বোচ্চ দর প্রস্তাব করেছেন মো. আলী ৫৬ লাখ এক হাজার টাকা। এ ছাড়া আনোয়ার হোসেন ৪৭ লাখ ১০ হাজার, এখলাস উদ্দিন রুবাইয়াত ৩০ লাখ, বাবু ভূঁইয়া ৫৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা দর প্রস্তাব করেন। ২০১৩ সালে এই হাট ২৭ লাখ এক হাজার টাকা দরে ইজারা দেয়া হয়। গোলাপবাগ পশুর হাটের জন্য বিক্রি হওয়া নয়টি সিডিউলের মধ্যে জমা পড়েছে সাতটি। এই হাটের জন্য সর্বোচ্চ ১০ লাখ ১০ হাজার টাকা দর প্রস্তাব করেছেন মো. হামিদুল্লাহ। অন্যান্যের মধ্যে নজরুল ইসলাম নিপু দর দিয়েছেন নয় লাখ ৮০ হাজার টাকা, হাজী মো. শহিদুল্লাহ দর দিয়েছেন ছয় লাখ টাকা, আনোয়ার আলী মাতবর সাত লাখ ২০ হাজার টাকা, মুক্তার হোসেন দর দিয়েছেন পাঁচ লাখ টাকা, মো. জাফর উল্লাহ দর দিয়েছেন চার লাখ ২০ হাজার টাকা, জমির আলী দর দিয়েছেন চার লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে এই হাট ৬১ লাখ ৬৬ হাজার টাকায় ইজারা দেয়া হয়। উত্তর শাহজাহানপুর পশুর হাটের জন্য নুরন্নবী রাজু দর প্রস্তাব করেছেন পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকা, হামিদুল হক শামীম দর দিয়েছেন চার লাখ ৫০ হাজার টাকা, কামরুজ্জামান কমল দর দিয়েছেন চার লাখ ৩০ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে এই হাট পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার টাকায় ইজারা দেয়া হয়। ধুপখোলা পশুর হাটের জন্য আনোয়ার হোসেন দর দিয়েছেন ছয় লাখ ৮০ হাজার টাকা, হাজী মুহাম্মদ শামসুজ্জোহা ১০ লাখ আট হাজার টাকা এবং এসএম হোসেন কাজল দর দিয়েছেন চার লাখ টাকা। ২০১৩ সালে এই হাট ইজারা হয় নয় লাখ ৪৬ হাজার টাকায়। গোপীবাগ পশুর হাটের জন্য ইলিয়াস খন্দকার দর দিয়েছেন ১৬ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা, শহিদউদ্দিন আহমেদ ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা এবং সুলতান মিয়া ২৩ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টাকা দর দিয়েছেন। ২০১৩ সালে এই হাটের জন্য সর্বোচ্চ ২১ লাখ টাকায় ইজারা দেয়া হয়। পোস্তগোলা পশুর হাটের জন্য হাজী মো. রুবেল দর দিয়েছেন ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা, ঢালী মামুনুর রশীদ দর দিয়েছেন নয় লাখ ৩০ হাজার টাকা, দেলোয়ার হোসেন দুলাল নয় লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং শাহনুর রহমান গাজী নয় লাখ টাকা। ২০১৩ সালে এই হাট ইজারা হয় নয় লাখ ৬০ হাজার টাকায়। কামরাঙ্গীরচর ইসলাম চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশের নতুন পশুর হাটের জন্য হাজী মো. সোলাইমান কোন দর উল্লেখ করেননি। এ ছাড়া হাজী মো. আবুল হোসেন সরকার দর দিয়েছেন এক লাখ ১০ হাজার টাকা, মো. হোসেন দর দিয়েছেন ৭০ হাজার টাকা। ডিসিসির নতুন আরেকটি হাট লালবাগের হাজী দেলোয়ার হোসেন খেলার মাঠের জন্য তিনজন দরপত্র জমা দেন। এই হাটের জন্য সর্বোচ্চ দর দিয়েছেন শেখ মো. আলমগীর এক কোটি এক লাখ ১১০০ টাকা, সাকির আহমেদ দর দিয়েছেন ৮২ লাখ ৫০০০ টাকা এবং ইলিয়াস রশীদ দর দিয়েছেন ৬৫ লাখ টাকা। এ প্রসঙ্গে ডিসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. খালিদ আহম্মেদ জানান, কোন হাটের দর বিগত দুই বছরের গড়ে সমান না হয়, তাহলে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হবে। তবে এখনও কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন মূল্যায়ন কমিটি বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন বলে জানান তিনি। এদিকে মঙ্গলবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৮টি অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারার দরপত্র জমা নেয়া হয়। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে ৬০টি সিডিউল বিক্রি হলেও জমা হয়েছে ৭টি হাটের জন্য ২৪টি দরপত্র। অপর একটি ঢাকা পলিটেকনিকের খেলার মাঠের জন্য কোন দরপত্র জমা পড়েনি। ৮টি কোরবানির পশুর হাট হলো- আগারগাঁও, খিলক্ষেত, উত্তরার আজমপুর, উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ, তেজগাঁও পলিটেকনিকের মাঠ, বারিধারা জে ব্লক, মিরপুর-৬ এবং বনানী রেলস্টেশন সংলগ্ন খালি জায়গা। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা একই কায়দায় এই ৮টি পশুর হাটেও তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।