সমাবেশে আইভি রহমানের পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম। আমি আইভি রহমানকে ডাকি আইভি আন্টি বলে। ইচ্ছা ছিল সভা শেষে কথা বলবো। আন্টি আমাকে বললেন, তুমি থাকো। আপাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে কথা বলবো। আমার সঙ্গে থাকা অন্যরা চলে যায় বায়তুল মোকাররমের গেটের দিকে। আমি অপেক্ষায় থাকি কখন কথা বলার সুযোগ পাই। অকস্মাৎ ১৮-১৯ বছরের একটি ছেলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে মঞ্চের পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি আইভি আন্টিকে জানাই ছেলেটি আমাকে ধাক্কা দিয়ে মেয়েদের দিকে দাঁড়িয়ে আছে। আইভি আন্টি মঞ্চ থেকে ছেলেটিকে সরে দাঁড়ানোর কথা বলতেই সে বলে ওঠে, এখানে থাকার নির্দেশ আছে। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় আহত রুমা মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে একথা বলেন। পুরো নাম রাশেদা আক্তার রুমা। শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টারের ক্ষত নিয়ে বাঁচার লড়াই করছেন ১০ বছর ধরে। তীব্র যন্ত্রণা সইতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে ঘরের জিনিস ভাঙচুর করেন। গ্রেনেড হামলার ভয়াবহ বীভৎসতার কথা মনে করে কেঁদে ওঠেন। ২১শে আগস্টের ভয়াল সেই দিনের কথা মনে করে রুমা বলেন, সেদিন সবার কাছে মৃত ছিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মৃত ঘোষণার পর আমার দেহ কাফনে ঢেকে দেয়া হয়েছিল লাশের সারিতে। সেই মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে এসেছি। কিন্তু মৃত্যু যন্ত্রণা আজও তাড়া করে ফিরছে। ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দ এখনও ভেসে আসে কানে। ৩৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর মহিলা লীগের সদস্য রাশেদা আক্তার রুমা বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিকভাবে কিছুই করতে পারছেন না। শরীরে থাকা স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। একটি কিডনি অকেজো হয়ে গেছে। কানেও ভাল শুনতে পারেন না। নিয়মিত চিকিৎসাও করতে পারছেন না। শরীরের যন্ত্রণা যখন বেড়ে যায় তখন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যান। মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। এখন শুধু একটা কথাই বলেন, সেদিন যদি মরে যেতাম তাহলে আজ এত কষ্ট সইতে হতো না। ২০১০ সালের ২১শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের মহাসমাবেশ ছিল। সেখানে মেয়র হানিফ সাহেবের ছেলে সাইদ খোকনের নেতৃত্বে কোতোয়ালি থানা থেকে আমরা একটি মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেই। সেখান থেকে আমাদের ৩২ নম্বর পর্যন্ত যাওয়ার কথা ছিল। সমাবেশে যাওয়ার পর আইভি আন্টির সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি তার পাশে যাই। আন্টিকে গিয়ে বললাম, আন্টি আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। তখন তিনি আমাকে বললেন, একটু দাঁড়াও আমি আপাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এসে কথা বলছি। সে সময় সমাবেশে আমাদের সঙ্গে যাওয়া সব মহিলা চলে যান বাইতুল মোকাররমের বাম দিকের গেটে। আমি আইভি আন্টির সঙ্গে কথা বলার জন্য সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। তখন আমার সামনে এসে দাঁড়ায় ১৮-১৯ বছরের একটি ছেলে। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ছেলেটা মুখের সামনে চলে আসে। তার এ অবস্থা দেখে আমি আন্টির কাছে বললাম, দেখেন আন্টি ছেলেটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে মহিলাদের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। আন্টি তখন ছেলেটিকে বললেন, এই ছেলে তুমি এখানে কেন এসেছো? তুমি ছেলেদের দিকে গিয়ে দাঁড়াও। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি বলে উঠলো, আমাদের এখানে থাকার নির্দেশ আছে। তখন আন্টি বললেন, কে নির্দেশ দিয়েছে? ছেলেটি অফিসের সামনের বিল্ডিংয়ের ছাদে কালো পোশাক পরা এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে বলে, উনি বলছে এখানে থাকার জন্য। আন্টি ভাবলেন র্যাবের লোক। তাই আর কিছু বলেননি। আপার গাড়ির সামনে যাওয়ার জন্য আমি আর আন্টি পা বাড়াই। এক পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যখন আপা বলে উঠলেন ‘জয় বাংলা’ ঠিক সেই সময় বিকট আওয়াজে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণ হওয়ার পর আমি কিছুই বলতে পারি না। সেই সময় কয়টা বাজে সকাল না বিকাল কিছুই বুঝতে পারি না। আমি উড়ে গিয়ে কোথায় পড়লাম, আন্টি কোথায় পড়লেন- কিছুই বলতে পারি না। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি। আমার দুই পা ভেঙে যায়। সেখানে পড়ে থাকার পর প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়- তখন আমার কানে ভেসে আসে কান্না, আর্তনাদ আর চিৎকার। খুব কষ্ট করে চোখ খুলে দেখি চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত। স্যান্ডেল পড়ে আছে সব দিকে। পড়ে থাকা অবস্থায় মুখ ঘুরাতেই দেখি আইভি আন্টি বসে আছেন। উনার দুই পা উড়ে গেছে। সেই সময় আমি ‘যুগান্তরে’র এক সাংবাদিককে দেখতে পাই। হাত দিয়ে ইশারা ঘরে তাকে ডাকি, আমাকে একটু পানি দেয়ার জন্য। পানি চাওয়ার পর আবার আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। তারা আমাকে রাস্তা থেকে তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা আমাকে মৃত ঘোষণা করেন। কোন চিকিৎসা না করে আমাকে লাশের পাশে রেখে দেয় সাদা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে। সে সময় মিরপুরের চায়না নামের একটি মেয়ে দেখতে পায় সাদা কাপড়ের নিচে আমি নড়াচড়া করছি। সেই মেয়েটি তখন ছুটে গিয়ে সাবের ভাইকে বললো, ভাই এই মেয়েটা জীবিত আছে। আমি শুনতে পাচ্ছি। সেই সময় সাবের ভাইয়ের গাড়িতে করে আমাকে ধানমন্ডি ২৭-এর বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার পর ডাক্তার বললেন, আমাকে বাঁচাতে হলে অনেক রক্ত লাগবে, আর দু’টি পা কেটে ফেলতে হবে। তা নাহলে আমাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। ঠিক সে সময় মেডিকেলে আমাকে দেখতে যান আপার এপিএস জাহাঙ্গীর ভাই। তিনি ডাক্তারের কাছে আমার শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে ডাক্তার তাকে সব খুলে বলেন। জাহাঙ্গীর ভাই তখন ডাক্তারকে বললেন, রুমার পা কাটার দরকার নেই। আমি তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাবো। সেখানে নেয়ার পর তিনিই চার ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করলেন। দুই দিন পঙ্গু হাসপাতালে আমার চিকিৎসা হয়। তখনও আমার জ্ঞান ফিরেনি। অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। জ্ঞান ফেরার পর আমি সব কথা জানতে পারি। ২৪শে আগস্ট আমিসহ ৪৯ জনকে সন্ধ্যায় কলকাতা প্যারালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে নেয়ার পরও ডাক্তার আমাকে মৃত ভেবে কোন চিকিৎসা করেননি। পরে ডাক্তারকে অনুরোধ করা হয়। তিনি রাত ২টায় আমাকে দেখতে আসেন। সারা শরীর পরীক্ষা করে দেখেন প্যারালাইজড হয়ে গেছে। কোন রগ কাজ করছে না। তখন গলায় আঙুল দিয়ে দেখেন সেই জায়গায় রগ কাজ করছে। তখন ব্লেড নিয়ে গলার রগ কেটে দিয়ে সেই জায়গা দিয়ে সেলাইন, রক্ত, ওষুধ সব পুশ করেন। অপারেশন শুরু করার আগে ডাক্তার জানালেন ২০ ব্যাগ রক্ত লাগবে। আমার স্বামী নেই, ভাই নেই, বাবা নেই। আমি একা ছিলাম হাসপাতালে। এই ২০ ব্যাগ রক্ত হাসপাতালে থাকা সবাই দিয়েছে আমাকে বাঁচানোর জন্য। সেদিন এমপি ঝুমু আপা (আসমা জেরিন ঝুমু)-র ভাইও আমাকে এক ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন। অপারেশনের ৪ দিন পর আমার জ্ঞান ফেরে। অপারেশনের পর আস্তে আস্তে পুরো শরীরে অনুভূতি আসতে থাকে। কিন্তু তখনও আমি মুখে কিছু বলতে পারি না। ডাক্তার এসে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলোতে টোকা দেন আমার জ্ঞান ফেরানোর জন্য। তখন আমি ব্যথা অনুভব করছিলাম, কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারছিলাম না। সব কিছু শুনছিলাম- নার্সরা আমার চোখে পানি দিচ্ছে, কথা বলছে। কিন্তু আমি তাদেরকে তখনও বলতে পারছিলাম না যে আমি বেঁচে আছি। এই কথাটা বলার জন্য আমি অনেক চেষ্টা করেছি। ৪ দিন পরে জ্ঞান ফিরে আসার পর আমি চোখে দেখতে পারছিলাম না। তখন কান্নাকাটি করতে শুরু করি। তখন ডাক্তার আমাকে বলেন, আপনি চোখে দেখতে পাবেন। রক্ত শূন্যতার জন্যই এই সমস্যা হচ্ছে। সেই অপারেশনের পর প্রায় ৪-৫ মাস সেখানে ছিলাম। জিল্লুর ভাই আমাকে দেখতে গেছেন সেখানে। কলকাতার সাংবাদিকদের কাছে আমাকে নিয়ে কথা বলেছেন। সংবাদও প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে ফিরে এলেও শরীরের যন্ত্রণা কমেনি। তিন বছর পর্যন্ত হুইল চেয়ার ব্যবহার করেছি। এরপর ক্রাচ ব্যবহার করি। এই হুইল চেয়ারে বসেই আমি মিটিং মিছিল সমাবেশ সব করেছি। আপা সাব জেলে ছিলেন তখনও গিয়ে সেখানে বসে থেকেছি। আসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করার পর শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। সেখানেও এই হুইল চেয়ারে করেই যাই। ১০ বছর হয়ে গেল এখনও শরীরের ক্ষত ভরাট হয়নি। রুমা বলেন, আপা ছিলেন বলেই আজ আমরা বেঁচে আছি। তাই আল্লাহর কাছে সব সময় দোয়া করি তিনি যেন বেঁচে থাকেন। তিনি বাঁচলেই আমরা বেঁচে থাকবো। তিনি যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন আমার কোন সমস্যা হলে আপার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতাম। কিন্তু এখন তা পারি না। তিনি প্রধানমন্ত্রী, অনেক ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু আমাদের দলের যে মন্ত্রী-এমপিরা আছেন তারাও আমাদের কোন খোঁজ নেননি এখনও। তারা যদি আমাদের দিকে একটু দেখতেন তাহলে এত কষ্ট করতে হতো না। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কতদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি কিন্তু তিনি কোন সাহায্য করেননি। রুহুল হক যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলেন উনার কাছে চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলার পর তিনি আমাকে বলেন, টাকা নিয়ে আসো তাহলে চিকিৎসা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আরেফিন স্যার (আ.আ.ম.স আরেফিন সিদ্দিক) আমাদের চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বলেছেন, আমাদেরকে জার্মানি পাঠানোর জন্য। কারণ, এই চিকিৎসা জার্মানিতে করানো সম্ভব। ২০-২৫ লাখ টাকা লাগবে বলে তিনি আমাদের পাঠাননি। এই টাকা তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেবেন না। টাকা দেবেন সরকার। তিনি শুধু আমাদের হয়ে একটু বলবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। আরেফিন স্যার রাষ্ট্রপতির কাছেও আমাদের জন্য চিঠি পাঠিয়েছেন। এখন আমার চিকিৎসার খরচ নিজেকে চালাতে হয়। আপা যে টাকা আমাকে দিয়েছেন তা দিয়ে চিকিৎসার খরচ হয় না। চিকিৎসার জন্য স্বামীর ভিটাও বিক্রি করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, চিকিৎসক বলেছেন আমি যে কোন সময় মারা যেতে পারি। নিয়মিত চিকিৎসা চালাতে পারলে মনে হয় আরও ক’টা দিন বেঁচে থাকতে পারতাম। ২০০২ সালে স্বামী জাহাঙ্গীর মারা যাওয়ার পর দুই মেয়েকে নিয়েই কাটে তার জীবন। গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর নিজের জীবন অনিশ্চিত ভেবে অল্প বয়সে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। তিনি বলেন, যে বয়সে আমার মেয়েদের পড়াশোনা করার কথা ছিল সেই বয়সে তারা স্বামীর সংসার করছে। আজ আমার তাদেরকে খাওয়ানো ও দেখাশোনার কথা ছিল। কিন্তু তারা আমাকে দেখাশোনা করছে। খাওয়ানো, গোসল করানো, ডাক্তার দেখানো সব করছে তারা। স্বামীর ভিটা বিক্রি করার পর থেকে মেয়েদের কাছেই থাকি। কখন আমার কি হয়ে যায়, তা বলতে পারি না।