স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের পদ্ধতি

স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে। এসব পদ্ধতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগের অবস্থা বোঝা যায়।

ম্যামোগ্রাফি
স্তনের এক্স-রেকে বলা হয় ম্যামোগ্রাফি। স্তনে কোনো রোগ হয়েছে কি না তা শনাক্ত করার জন্য এ পরীক্ষা করা হয়। ম্যামোগ্রাফি দুই ধরনের।

ডায়াগনোস্টিক ম্যামোগ্রাফি
স্তনে কোনো সমস্যা, যেমন—স্তনে চাকা, বৃন্ত থেকে রক্তক্ষরণ, ত্বক পুরু হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হলে রোগনির্ণয়ে ডায়াগনোস্টিক ম্যামোগ্রাফি করা হয়। এ পরীক্ষায় রোগ শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী এক্স-রে করা হয়।

স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফি
স্তনে কোনো সমস্যা না হলেও রোগ আছে কি না তা জানার জন্য যে ম্যামোগ্রাফি করা হয়, তা হলো স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাফি। এ ধরনের ম্যামোগ্রাফিতে প্রতিটি স্তনের দুটি করে (দুভাবে তোলা) এক্স-রে ফিল্ম করা হয়।
এক্স-রে হলো তেজস্ক্রিয় রশ্মি যা স্তন ক্যানসার হওয়ার জন্য একটি দায়ী উপাদান। তবে ম্যামোগ্রাফি করতে যে এক্স-রে করা হয় তাতে খুব সামান্যই তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহূত হয়। যদি ৪০ বছরের পর থেকে দু-এক বছর অন্তর ম্যামোগ্রাফি করা হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণিত হলে ক্ষতির চেয়ে লাভ অনেক বেশি হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। তাই আন্তর্জাতিকভাবে ম্যামোগ্রাফি স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং একটি শক্তিশালী মাধ্যম বলে বিবেচিত। অল্পবয়সী নারীর স্তনগ্রন্থি অত্যন্ত ঘন হয়ে থাকে। ম্যামোগ্রাফিতে কোনো সন্দেহজনক ইমেজ বা ছবি থাকলে তা স্তনের ঘন গ্রন্থির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। এ ছাড়া অল্পবয়সী নারীদের বারবার অহেতুক ম্যামোগ্রাফি করা হলে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

যাদের ম্যামোগ্রাফি করা দরকার
সাধারণত ৪০ বছর পার হলেই দু-এক বছর পরপর এ পরীক্ষা করা যায়। তবে কোনো কোনো দেশে ৫০ বছর থেকে ৬৯ বছর পর্যন্ত নিয়মিত ম্যামোগ্রাফি করার কথা বলা হয়েছে।
স্তন ক্যানসারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হলে ৪০ বছরের আগেই পরীক্ষা করা যেতে পারে, তবে এ ক্ষেত্রে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে।

ম্যামোগ্রাফি কীভাবে করা হয়
ম্যামোগ্রাফি টেকনোলজিস্ট ম্যামোগ্রাফি যন্ত্রের দুই প্লেটের মধ্যে স্তন সেট করেন। স্তনে বেশ একটু চাপ দিতে হয়, যাতে স্তন যতটা সম্ভব সংকুচিত এবং সমান হয়। কয়েক সেকেন্ডের এক্স-রে দিয়ে ম্যামোগ্রাফি হয়ে যায়। ম্যামোগ্রাফি করতে সামান্য ব্যথা হয়। কারও কারও অস্বস্তি বোধ হয়, তবে তা খুবই অল্প সময়ের জন্য।

ম্যামোগ্রাফিতে কী দেখা হয়
ম্যামোগ্রাফি ফিল্মে স্তনের স্বাভাবিকতা থেকে কোনো পরিবর্তন আছে কি না, তা দেখা হয়।
স্তনটিস্যুতে ক্যালসিফিকেশন বা ক্যালসিয়াম ধাতু জমা হওয়া যা ম্যামোগ্রাফি ফিল্মে সাদা দানার মতো দেখায়। ক্যানসার হলে বা না হলেও এ রকম ক্যালসিয়াম ধাতু জমা হতে পারে। সাধারণত বয়স হলে বা স্তনে কোনো প্রদাহ, আঘাতজনিত কারণে মোটা দানা (ম্যাক্রোক্যালসিফিকেশন) হয়ে থাকে, তা ক্যানসার হিসেবে সন্দেহ করা হয় না। কারণ, বেশির ভাগ নারীর স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের ক্যালসিফিকেশন দেখা যায়।
খুব মিহি বা চিকন দানা (মাইক্রোক্যালসিফিকেশন) একটি বা একাধিক সন্নিবেশিত থাকলে, তা সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে এর অর্থ এ নয় যে ক্যানসার হয়েছে। রেডিওলজিস্ট ম্যামোগ্রাফি ফিল্মে মিহি ক্যালসিয়াম দানার উপস্থিতি, সন্নিবেশনের ধরন এবং অন্যান্য অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ক্যানসার সন্দেহ করলে বায়োপসি করার জন্য উপদেশ দেবেন।

স্তনে চাকা বা পিণ্ডের ছবিতে ক্যালসিয়াম ধাতু জমা হতেও পারে আবার নাও পারে। এটি ম্যামোগ্রাফির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ চাকা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে; যেমন—সিস্ট (তরল-ভর্তি পর্দাঘেরা বল, যা ক্যানসার নয়), শক্ত সলিড বল (ফাইব্রোএডেনমা টিউমার কিন্তু ক্যানসার নয়)। তবে কোনো কোনো সলিড টিউমারে ক্যানসার থাকতে পারে। চাকা সিস্ট হলে বায়োপসি করার প্রয়োজন হয় না।
শারীরিক পরীক্ষা করার সময় যে রকম চাকা অনুভব করা যায়, ম্যামোগ্রাফিতেও তেমন দেখা যায়। তবে চাকাটি সলিড না সিস্টিক, ম্যামোগ্রাফিতে তা পার্থক্য করা যায় না, আলট্রাসনোগ্রাফি করে তা ভালোভাবে বোঝা যায়। অন্যভাবে খুব সরু সুঁইযুক্ত সিরিঞ্জ দিয়ে তরল বের করে আনা যেতে পারে।
চাকাটি যদি সিস্ট না হয়ে থাকে, বা চাকার ধরন যদি খানিকটা সিস্ট, খানিকটা সলিড হয়ে থাকে, তাহলে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রেডিওলজিস্ট উপদেশ দিতে পারেন কিংবা কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখতে পারেন অথবা ক্যানসার সন্দেহ করলে বায়োপসি করার জন্য তিনি উপদেশ দেবেন। আগে কখনো ম্যামোগ্রাফি করা থাকলে, তা অনেক গুরুত্ব বহন করে। নতুন ম্যামোগ্রাফির সঙ্গে তুলনা করে রিপোর্ট করা সহজ হয়।

ম্যামোগ্রাফির সীমাবদ্ধতা
ম্যামোগ্রাফি ফিল্মে সন্দেহজনক এলাকা নির্দেশ করা যায় কিন্তু ক্যানসার হয়েছে তা নিশ্চিত করা যায় না। সন্দেহজনক স্থান থেকে বায়োপসি নিয়ে প্যাথলজি পরীক্ষায় তা নিশ্চিত করা হয়।
মনে রাখতে হবে, ম্যামোগ্রাফি করা হয় সন্দেহজনক এলাকা নির্দেশ করার জন্য। কখনো কখনো ম্যামোগ্রাফি চাকার ছবি ধারণ করতে পারে না। তাই শারীরিক পরীক্ষা করার সময় যদি হাতে চাকা অনুভূত হয়, তবে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে এবং দরকার হলে বায়োপসি করাতে হবে। সে ক্ষেত্রে যদি ম্যামোগ্রাফি পরীক্ষায় স্তনের স্বাভাবিক রিপোর্টও হয়, ম্যামোগ্রাফি সন্দেহজনক এলাকা নির্ধারণে শতভাগ সফল হয় না। যেমন, অল্প বয়স্ক নারী, গর্ভবতী, শিশুকে দুধদানকারী মা এবং বয়স্ক নারী যাঁর স্তনগ্রন্থি খুব ঘন হয়ে সন্নিবেশিত, ম্যামোগ্রাফিতে গ্ল্যান্ড টিস্যুর আড়ালে এসব এলাকা ঢেকে যায়। তাই ঝুঁকিপূর্ণ হলে অন্যান্য পরীক্ষা, যেমন আলট্রাসনোগ্রাফি ও এমআরআই করা হয়।

আলট্রাসনোগ্রাফি
এটি এক ধরনের পরীক্ষা যা শব্দতরঙ্গ প্রতিফলিত করে শরীরের ভেতরের বিভিন্ন স্থানের ছবি তৈরি করতে পারে। এতে এক্স-রের মতো তেজস্ক্রিয় রশ্মি বা শরীরের জন্য ক্ষতিকর কোনো রশ্মি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না। আলট্রাসনোগ্রাফি বা ব্রেস্ট আলট্রাসাউন্ড করে স্তনের ভেতরকার প্রায় সব অংশের ছবি ধারণ করা যেতে পারে। এমনকি বুকের কাছের স্তনটিস্যুর ছবিও এ পরীক্ষায় দেখা যায় যা ম্যামোগ্রাফিতে সম্ভব হয় না। তবে স্তন ক্যানসার স্কিনিংয়ে ম্যামোগ্রাফির বদলে ব্রেস্ট আলট্রাসাউন্ড নয় বরং ম্যামোগ্রাফির সহযোগী পরীক্ষা হিসেবে ব্রেস্ট আলট্রাসাউন্ডকে বিবেচনা করা হয়।
বর্তমানে স্তন ক্যানসার নির্ণয় করার লক্ষ্যে আলট্রাসাউন্ডের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ২০-৩০ বছর বয়সী, গর্ভবতী, শিশুকে দুধদানকারী মা ও ঘন স্তনগ্রন্থিসম্পন্ন নারীদের জন্য। কারণ এ পরীক্ষায় কোনো ধরনের ক্ষতিকারক এক্স-রে বা তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করা হয় না, তাই এ পরীক্ষা নিরাপদ।
এমনকি স্তনে সন্দেহজনক চাকা হলে, আলট্রাসাউন্ড গাইডে এফএনসি (সুঁই দিয়ে চাকা থেকে কোষ নিয়ে পরীক্ষা) করে রোগ শনাক্ত করা যায়।

এমআরআই
এটি এক ধরনের রেডিওলজি ইমেজিং পরীক্ষা। এতেও এক্স-রের মতো তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহূত হয় না। তাই এ পরীক্ষা অনেকটা নিরাপদ। কম বয়সী ঝুঁকিপূর্ণ মহিলাদের ম্যামোগ্রাফির সঙ্গে স্তনের এমআরআই করে স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং করা হয়। তবে এ পরীক্ষা ব্যয়বহুল।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *