হঠাৎ করেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আশঙ্কাজনক হারে খুন-হত্যা বেড়ে গেছে। রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে টেলিভিশনের ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও বাসায় ঢুকে গুলি করে তিন জনকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এই সময়ে সারা
দেশে আরও অন্তত সাত জন খুন হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে সাধারণ মানুষ কেউ বাদ যাচ্ছে না খুনিদের তালিকা থেকে। বেড়ে গেছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। দিন-দুপুরে ফিল্মি স্টাইলে গুলি ও বোমাবাজি করে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অর্থ। রাজপথ কিংবা বেডরুম সব জায়গায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীসহ সারা দেশে খুন হওয়া চাঞ্চল্যকর বেশির ভাগ মামলার আসামিরাই গ্রেপ্তার হয়নি। তদন্তের অগ্রগতিও শূন্য। পুলিশের নিষ্প্রভতায় খুনি গ্রেপ্তার ও অপরাধীদের সাজা না হওয়ায় এ ধরনের লোমহর্ষক ঘটনা বেড়েই চলেছে বলছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।
মগবাজারের ট্রিপল মার্ডারের ঘটনার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। দোষীদের গ্রেপ্তারের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রায় একই রকম দাবি করেন পুলিশের আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। তারা বলছেন, খুনের ঘটনা বাড়লেও তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা বা ব্যর্থতার জন্য নয়। ব্যক্তিগত কারণে কেউ কাউকে হত্যার উদ্দেশে টার্গেট করলে তা ঠেকানো দুষ্কর।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতারা। কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে কড়া সমালোচনা করলেও কেউ আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সুরে সুর মেলাচ্ছেন। গতকাল এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, রাজধানীতে পরপর খুনের ঘটনায় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ঘরের মধ্যে এসে মানুষ খুন করে যাবে, এ অরাজকতা চলতে পারে না। পুলিশ বাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন, ফারুকী হত্যা ও মগবাজারের তিন খুন স্বাভাবিক ঘটনা। উন্নত দেশেও এরকম দুর্ঘটনা ঘটে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের গত জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। জুলাই মাসে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা দেশে ৪০৬টি মামলা হয়েছে। জুন মাসে সারা দেশে খুন হয়েছিল ৩৯২ জন, মে মাসে এই সংখ্যা ছিল ৩৭০, এপ্রিলে খুন হয় ৪০১টি, মার্চ মাসে ৩৬৯, ফেব্রুয়ারিতে ৩২৮টি এবং জানুয়ারাতি খুনের সংখ্যা ছিল ৪০৩টি। চলতি মাসে পরিসংখ্যান তৈরি না হলেও খুনের ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। গত ছয় মাসের ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার খুনের চিত্রে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় জানুয়ারি মাসে ১৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬, মার্চে ১৯, এপ্রিলে ২৪, মে মাসে ২১, জুন মাসে ২৬ ও জুলাই মাসে ২৫ জন। চলতি মাসে ইতিমধ্যে ৩০ জন ছাড়িয়ে গেছে। সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরে সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ১৪টি খুনের ঘটনা ঘটছে। তবে প্রকৃত খুনের ঘটনা আরও বেশি। অনেক ঘটনায় থানায় মামলা হয় না। অজ্ঞাত মৃতদেহ, রহস্যজনক মৃত্যু অথবা পারিবারিক কলহের ঘটনায় যেসব লাশ উদ্ধার করা হয়, পুলিশ এগুলোকে অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে মামলা নথিভুক্ত করে। ফলে ওই সব ঘটনায় হত্যা মামলা না হওয়ায় খুনের প্রকৃত পরিসংখ্যান পুলিশের তালিকায় উল্লেখ থাকে না।
সূত্র জানায়, রাজধানীসহ সারা দেশেই সম্প্রতি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। পেশাদার খুনিদের পাশাপাশি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় খুনের ঘটনা ঘটছে। অপরাধীদের ব্যাপারে দুর্বল আইনি ব্যবস্থা আর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে হত্যাকাণ্ডের মত বড় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তবে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব বা পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বের জের ধরে ঘটা খুনের ঘটনা আগে থেকেই ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব না। তবে খুনের ঘটনায় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার যেভাবে বেড়েছে তা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মানবাধিকার কর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তাই খুনাখুনিসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে একের পর ঘটছে খুনখারাবিসহ নানা রকম অপরাধের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, বর্তমান সময়ের বেশির ভাগ হত্যা মামলা তদন্তের একই অবস্থা। অপরাধীর শাস্তি না হলে অপরাধের প্রবণতা বেড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা আর দক্ষতার অভাবে অপরাধীরা ধরা পড়ে না। এছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর রাজনীতিবিদদের ঢালাও মন্তব্য মামলার তদন্ত বিঘ্ন ঘটায়। সমাজে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে।