শায়খ নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে ধর্মীয় মতভেদের বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উগ্রপন্থি ধর্মীয় কোন দল বা গোষ্ঠী এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে বলে তাদের ধারণা। হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা আগে ফারুকীর বাসায় এক রহস্যময় নারী অবস্থান করছিলেন। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ধারণা, হত্যাকারীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে ওই নারীর। রহস্যময় ওই নারীকে খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়াও ফারুকীর ব্যবসা ও পারিবারিক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা হচ্ছে। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে মামলাটির তদন্ত চলছে। এর মধ্যে রহসজ্যনক সেই নারীর বিষয়টিও রয়েছে। তিনি জানান, তারা উগ্রবাদী ধর্মীয় সংগঠনে জড়িত থাকার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি, সিআইডি, র্যাবসহ অন্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও ছায়া তদন্ত করছে। সিআইডি সূত্র জানায়, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা আলামতগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে ফারুকীর হাত-পা বাঁধার কাপড় ও দরজার হাতল থেকে হাতের ছাপ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (পশ্চিম) আশিকুর রহমান বলেন, ঘটনার পর থেকেই খুনিদের শনাক্ত করতে কাজ করে যাচ্ছে ডিবি। ম্যানুয়ালি ও প্রযুক্তিগত ভাবে মামলার তদন্ত চলছে। তবে গতকাল পর্যন্ত কোন ক্লু পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, খুনিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে র্যাব তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। তবে বলার মতো এখনও কোন অগ্রগতি তাদের হাতে নেই।
পুলিশ ও পরিবারের সদস্যরা জানায়, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আগে ফারুকীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় প্রায় দেড় ঘণ্টা অবস্থান করছিল এক নারী। বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে ওই নারী ফারুকীর বাসায় প্রবেশ করেন বলে জানান ওই সময়ে বাসায় অবস্থানকারী আহমেদ নুরী (১৮)। রাজধানীর মুহাম্মদপুরের কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদরাসার ছাত্র নুরী ফারুকীকে বাবা বলে সম্বোধন করেন। নুরী জানান, ঘটনার দিন গত বুধবার দুপুর থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বাসায় ছিলেন তিনি। বেলা সাড়ে ৩টার সময় ফারুকীর মোবাইল ফোনে এক অচেনা নারী কল দিয়ে কথা বলেন। কথা বলার একপর্যায়ে ওই নারীকে বাসায় আসতে বলেন ফারুকী। তিনি বলেছিলেন, নাজনীন স্কুলের (নাজনীন স্কুল এন্ড কলেজ) সামনে এসে আমার কথা বললেই যে কেউ বাসা দেখিয়ে দিবে। অথবা আপনি এখানে এসে আমাকে কল দিয়েন। ফোনে কথা বলা শেষে ফারুকী জানিয়েছিলেন, বরিশালের শর্শিনা পীরের মাজার থেকে এক মহিলা ঢাকায় এসেছেন তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। বিকাল ৪টার পর ওই মহিলা আবার মোবাইলফোনে কল দিয়ে জানান তিনি স্কুলের পাশে। ফারুকী তখন আহমেদ নুরীকে বলেন, যাও বাবা ওই মহিলাকে স্কুলের সামনে থেকে নিয়ে এসো। নুরী স্কুলের পাশে গেলেও ওই নারীকে পাওয়া যায়নি। পরে কলিংবেল বাজলে নুরী দরজা খুলে দিতেই বাসায় প্রবেশ করে ওই নারী। ড্রয়িংরুমে তখন দু’জন পুরুষ মেহমান থাকায় ওই নারীকে ফারুকীর বেডরুমে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান নুরী। রুমে বসে থাকা ফারুকীর পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে ওই নারী। কেঁদে কেঁদে সে বলছিল, আপনারে দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। তাই দেখতে আইছিলাম। আমার ইচ্ছে পূরণ হইছে। ফারুকী তখন তাকে কান্না থামিয়ে উঠে চেয়ারে বসতে বলেন। একপর্যায়ে ফারুকী অন্যরুমে চলে গেলে ফারুকীর স্ত্রী লুবনা কুলসুম তাকে নাস্তা দিতে বলেন। ফ্রিজ খুলে তখন মিষ্টি, তালের পিঠা ও খেজুর প্লেটে করে ওই নারীকে দিয়েছিলেন নুরী। ওই সময়ে লুবনাকে ওই নারী জানায় তার বাড়ি সাতক্ষীরা। ফারুকীর মেজ ছেলে ফয়সাল ফারুকী তখন ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করছিলেন। ফয়সালের সঙ্গেও কথা হয় ওই নারীর। ফয়সাল ফারুকী জানান, ওই নারীকে দেখে দরিদ্র মনে হয়নি। যদিও তার পরনে ময়লা জামা ছিল। একইভাবে আহমেদ নুরী জানান, তার পরনে জামা, সাদা রঙের স্কার্ফে ময়লা ছিল। স্কার্ফে পিঙ্ক রঙের ফুলের মতো কাজ করা ছিল বলে জানান নুরী। তিনি আরও জানান, ওই নারীর বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ হবে। তার গায়ের রং ফর্সা। তার ভাষায় আঞ্চলিকতা প্রকাশ পায়নি বলেও দাবি করেন নুরী। ফয়সাল ফারুকী জানান, ওই নারী তার বাবাকে জানিয়েছিল তার ছেলে বিয়ের পর তাকে দেখাশোনা করে না। এজন্য তিনি তার বাবা ফারুকীর দোয়া চাইতে এসেছেন। তিনি দেখেন, ওই নারী বাসার প্রতিটি রুমেই ঘুরে ঘুরে দেখছেন। ফয়সাল যখন খাবার খাচ্ছিলেন তখন ওই নারী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, অনেক দূর থেকে একটা কাজে আপনার আব্বার কাছে দোয়া চাইতে আসছি। ফয়সাল জানান, ওই নারী রাতে বাড়িতে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু তার বাবা এতে অসম্মতি জানিয়ে বলেন, আপনি কিছু মনে করবেন না। বাইরের কেউ বাসায় থাকলে বাড়িওয়ালা সমস্যা করে। রাত হয়ে যাচ্ছে, আপনি চলে যান। পরিবারের সদস্যরা জানায়, সন্ধ্যার দিকে ফারুকী তার ভাগ্নির ছেলে মেহেদী হাসানকে ডেকে ওই নারীকে রিকশায় তুলে দিতে বলেন। এ সময় ওই নারী একটি বোরকা পরে বাসা থেকে বের হয়। মেহেদি হাসান জানান, প্রথমে ওই নারী জানান তিনি গাউসিয়া যাবেন। রিকশা ঠিক করে দেয়ার পর ওই নারী জানান তিনি যাবেন গুলিস্তান। সন্ধ্যা ৬টায় ওই নারী চলে যাওয়ার প্রায় ১ঘণ্টা ২০ মিনিট পর কিলিং মিশনে অংশ নেয়া দুই যুবক হজ সংক্রান্ত আলোচনার অজুহাতে ফারুকীর বাসায় যান। পরে বাসায় ঢুকে আরও ৬ থেকে ৭ যুবক। তারা পরিবারের সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-পা-মুখ বেঁধে ফারুকীকে গলা কেটে হত্যা করে। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলানগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুন্সী সাব্বির আহমেদ জানান, ঘটনার দিন ফারুকীর বাসায় যাওয়া ওই নারীকে খোঁজা হচ্ছে।
পারিবারিক বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব নেই: নিহত মাওলানা ফারুকীর পরিবারের সদস্য ব্যবাসয়িক পার্টনারসহ বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফারুকীর সঙ্গে কারো পারিবারিক বা ব্যবাসায়িক কোন দ্বন্দ্ব নেই। নুরুল ইসলাম ফারুকীর ব্যবসায়ী পার্টনার বেলাল হোসাইন জানান, ফারুক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসে পাঁচ জন পরিচালক রয়েছেন। ব্যবসা নিয়ে কারও সঙ্গে ফারুকীর কোন বিরোধ ছিল না বলে জানান তিনি। বরং ফারুকীর ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা জানায়, ফারুকীর দুই স্ত্রী থাকলেও তাদের মধ্যে কোন ঝামেলা ছিল না। দুই বাসাতেই আসা-যাওয়া ছিল তার। এ বিষয়ে ফারুকীর ছোট ভাই আবদুর রউফ জানান, এই দুই পরিবারের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক। ফারুকীর বড় স্ত্রীর ছেলে মাসুদ রেজা ফারুকী একজন সরকারি কর্মকর্তা। এছাড়া তার মেয়ে হুমায়রা তাবাসুম তুবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও লাবনী লুবা ইডেন কলেজের ছাত্রী। ছোট স্ত্রীর বড় ছেলে আহমদ রেজা ফারুকী বাবার সঙ্গে ব্যবসায় সম্পৃক্ত। ছোট দুই ছেলে লেখাপড়া করছে।
জানাজায় মানুষের ঢল: এদিকে গতকাল দুপুর ১২ টায় নুরুল ইসলাম ফারুকীর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে। সেখানে জুমার নামাজের পর তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা ফারুকীর জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। এতে ইমামতি করেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকররমের খতিব মাওলানা মুফতি সালাহ উদ্দিন। নামাজে জানাজায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হক, হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর সভাপতি ইব্রাহিম বাহার, ইসলামি ফ্রন্টের সভাপতি নজিবুল বাশার মাইজভান্ডারি প্রমুখ। জানাজা শেষে মরহুমের লাশ পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নাউতাড়ি গ্রামের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ সকাল ১১টায় সেখানে নামাজে জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হবে।