আর্মি স্টেডিয়ামে ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র হাজার দশেক। ফ্রি টিকিট দিয়েও প্রথম ম্যাচে হাজার পাঁচেক দর্শকও টানতে পারেনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। যা-ও উপস্থিতি ছিল তাদের বেশির ভাগই সামরিক লোকজন। সিলেটের মাঠে দর্শক হবে না আগে তার ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। নেপাল-বাংলাদেশ ম্যাচ দেখতে দর্শকদের উন্মাদনা যে বাড়াবাড়িতে পরিণত হবে সেটার ধারণা বোধ হয় কেউ করেনি। খেলা হলেই দর্শকরা আসবেন এবং খেলা উপভোগ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গতকাল বাংলাদেশ ও নেপাল অনূর্ধ্ব-২৩ দলের মধ্যকার দ্বিতীয় প্রীতি ম্যাচে ঘটল উল্টো ঘটনা। খেলা মাঠে গড়ানোর আগেই দর্শকে পরিপূর্ণ হয়ে যায় সিলেটের জেলা স্টেডিয়াম। ২৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন জেলা স্টেডিয়ামে প্রায় তিনগুণ দর্শকের উপস্থিতি! ফুটবল দর্শকের অবাক ভালোবাসায় আয়োজকরা হতবাক। উপচে পড়া ভিড়ে মূল মাঠ সম্পূর্ণ পরিপূর্ণ হয়ে যায়। দর্শকের ভিড়ে মাঠ যেন খুঁজে পাওয়া দায়! দর্শকের ভিড়ে দু’দলের খেলোয়াড়রা মূল মাঠে বন্দি হয়ে পড়েন। নির্ধারিত সময়ের দীর্ঘ প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর মূল মাঠে দর্শকের উপস্থিতিতেই খেলা শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
অসহ্য গরম, কাঠ-পোড়া রোদ, কিছুতেই দমাতে পারে দর্শকদের। সব বাধা উপেক্ষা করে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে এসে হাজির হন ফুটবলপ্রেমীরা। সবার একটাই উদ্দেশ্য, আন্তর্জাতিক ফুটবলে জেলা স্টেডিয়ামের অভিষেক ম্যাচ দেখা। বল মাঠে গড়ানোর আগেই দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় ছিল লক্ষণীয়। স্টেডিয়ামের গ্যালারি যেন তিল ঠাঁই নেই। অপেক্ষমাণ দর্শকদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো প্রশাসনকেও। স্টেডিয়ামের ফটক ভেঙে স্রোতের গতিতে দর্শকরা মূল মাঠের খালি জায়গায় অবস্থান নেয়। মূল মাঠে দর্শকে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। কিছুতেই মূল মাঠ থেকে দর্শকদের হটাতে পারেনি প্রশাসন। যে কারণে দর্শকদের ভিড় সামাল দিতে গিয়ে নির্ধারিত সময়ে খেলা মাঠে গড়ানো সম্ভব হয়নি। ধারণা করা যাচ্ছিল খেলা হয়তো শুরুই করতে পারবেন না ম্যাচ কমিশনার মনিরুল ইসলাম। কারণ শুরুতে মাঠে পুলিশ ছিল মাত্র তিন শ’। তিন শ’ পুলিশ দিয়ে মাঠের নিরাপত্তা দেয়া কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে দর্শক। স্টেডিয়ামের কয়েকটি গেট ভেঙ্গে হুড়হুড় করে মাঠে প্রবেশ করতে থাকে। বাধ্য হয়েই আরও একশ পুলিশ বাড়িয়ে দেন আয়োজকরা। পরে পুলিশ দিয়ে মানব প্রাচীর তৈরি করায় ম্যাচ শুরুর সাহস করেন ম্যাচ কমিশনার। এ ব্যাপারে বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ বলেন, আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে পরিস্থিতিতে খেলা পরিত্যক্ত করা সম্ভব নয়, আবার চালু করাও ঝুঁকিপূর্ণ। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ দিয়ে মানব প্রাচীর তৈরি করে খেলা শুরু করেন ম্যাচ কমিশনার। বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পরও ম্যাচ কমিশনার কেন খেলাটি চালু করলেন এ বিষয়ে সোহাগ বলেন, আসলে পুলিশ দিয়ে মানব প্রাচীর তৈরি করার পর ম্যাচ কমিশনার রেফারিদের ম্যাচটি চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন। নিরাপত্তা ভেঙ্গে পরার কারণ জানতে চাইলে সিলেট ফুটবল এসোসিয়েশনের সভাপতি মাহি উদ্দিন সেলিম জানান, আসলে আমরা ২৫ হাজার টিকিট আগে বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু দর্শক মনে করেছে ম্যাচের আগে মাঠে গেলে টিকিট পাবে। তাই আরও ২০-৩০ হাজার দর্শকের সমাগম হয়। যা আমাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে ভিন্ন কথা, স্থানীয় ডিএফ সভাপতি গত তিন দিনে গ্যালারির আসনের অধীন টিকিট বিক্রি করেছেন। এছাড়া তাদের নির্দেশেই খেলার আগে স্টেডিয়ামে গেটগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। আর এ কারণেই ঝুঁকিতে পড়েছিল সিলেটে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তজার্তিক ম্যাচ। এখন ম্যাচটি সফল ভাবে শেষ হলেও দর্শকদের এই বাড়াবাড়ি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে বাফুফেকে।
দর্শকের চাপে বিধ্বস্ত সিলেট স্টেডিয়াম
দর্শকের ভারে বিধ্বস্ত হয়েছে সিলেট স্টেডিয়াম। পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন সতর্কতাই কাজে লাগলো না। সাইডলাইন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকলেন হাজার হাজার দর্শক। আর তারই মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলো। খেলাও পিছিয়ে গেল এক ঘণ্টা। খেলোয়ারড়া মাঝ মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন ফুটবলপাগল দর্শকের কর্মকাণ্ড। অঘটন শুরু বিকাল সাড়ে চারটায়। তখন সিলেট স্টেডিয়ামের ২নং ফটকের কাছে ঘটে গেল মর্মান্তিক ঘটনা। ওই এলাকায় আসন ক্ষমতার দিগুণ দর্শক প্রবেশ করেন সেখানে। এক সময় দর্শকের চাপে ভেঙে পড়ে ২নং ফটক। এ সময় ফটকের নিচে চাপা পড়েন কমপক্ষে ১০-১২ জন দর্শক। তাদের শরীরে পা দিয়ে হুড়হুড় করে শত শত দর্শক ঢুকে পড়েন মাঠে। শেষে পুলিশ যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলো তখন দুই দর্শক প্রায় রক্তাক্ত। তাদের তাৎক্ষণিক সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খেলা শুরু হওয়ার সব প্রস্তুতি শেষ। ক্ষাণিক পরেই বেজে উঠবে রেফারির বাঁশি। এ সময়ে উত্তরের ফটক ভেঙে ফেললেন দর্শকরা। আর ফটক ভেঙে একসঙ্গে মাঠে ঢুকে এলেন কয়েক হাজার দর্শক। এ দৃশ্য দেখে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে ছুটে গেলেও কিছুই করার ছিল না। গেট ভেঙে ঢুকে পড়া দর্শকের ঢলের কাছে অসহায় ছিলেন সবাই। দর্শকরা দলে দলে এসে মাঠের চারপাশে অবস্থান নেন। এ দৃশ্য দেখে মাঝ মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ ও নেপাল দলের খেলোয়াড়া একপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। এক সময় দর্শকরা এসে দখলে নেন দু’দলের খেলোয়াড়দের রিজার্ভ বেঞ্চ। দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেন রিজার্ভ বেঞ্চের সব কিছু। আর মাঠে তারা লাইন বরাবর বসে পড়েন। মাঠের চারপাশে বিজ্ঞাপনের ব্যারিকেড সারিটিও মুহূর্তে দর্শকের পায়ের কাছে অসহায় হয়ে গেল। কোন বিজ্ঞাপন ব্যারিকেড নয় দর্শকরাই জয় করে নিলেন পুরো মাঠ। খেলা শেষে সিলেট স্টেডিয়ামকে বিধ্বস্ত মনে হলো। চারটি ফটকই ভাঙাচোরা। এমনকি ভিআইপি ও প্রেস বক্সের কলাপসিবল ফটকগুলোও ভেঙে ফেলা হয়েছে। আর তা দেখে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়েছিল আয়োজকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ডিএফএ’র দিকে অভিযোগের আঙুল: সিলেট স্টেডিয়ামে দর্শক ধারণ ক্ষমতা সব মিলিয়ে ২৫ হাজার। কিন্তু গ্যালারিতে দর্শক ছিলেন প্রায় ৩০ হাজার। আরও ১৫ হাজার দর্শক ছিলেন মাঠে। ডিএফএ’র সভাপতি মাহিউদ্দিন সেলিম গতকালও জানিয়েছেন, ২৫ হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছে। মাঠে ঢুকে পড়া দর্শকরা হাতে হাতে টিকিট থাকার দৃশ্যটি দেখিয়েছেন বারবার। অভিযোগ উঠেছে, সিলেট ডিস্ট্রিক ফুটবল এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রায় ৪০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছে। এ কারণে ধারণ ক্ষমতার বেশি টিকিট বিক্রি করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।