আমরা প্রশাসনের লোক, বেশি কথা বললে গুলি করে দেবো’- এ কথা বলেই ক্যানসারে আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায় সাদা পোশাধারীরা। এরপর পাঁচ দিন পেরিয়ে গেছে তার আর খোঁজ মিলছে না। এ ব্যক্তির নাম জাহিদুল ইসলাম সোহেল (৩০)। দীর্ঘদিন সৌদি আরবে থাকার পর অসুস্থতার কারণে গত বছর তিনি দেশে ফেরেন। এরপর তার বোনম্যারো ক্যানসার ধরা পড়ে। রাজধানীর মগবাজারের সোনালীবাগের ৮৬/১ নম্বর বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। তার পিতা ইউনুছ আলীও সৌদি প্রবাসী। নিখোঁজ সোহেলের স্বজনরা জানান, ঘটনার পর থেকে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যালয়ে ঘুরছেন। এ বিষয়ে তারা বাড্ডা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। কিন্তু কেউ তার কোন সন্ধান দিতে পারছে না। সোহেলের স্বজনরা একবার ডিবি কার্যালয়ে, একবার র্যাব কার্যালয়ে ছুটছেন। বলছেন, সোহেল কঠিন রোগে আক্রান্ত। তার প্রতিদিন ওষুধ খেতে হয়। ওষুধ না খেলে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। ধীরে ধীরে তিনি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবেন। সোহেলের স্ত্রী তাসলিমা প্রতিদিন গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে যাচ্ছেন স্বামীর সন্ধান চেয়ে। সেখানেই তাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়।
আগামী ঈদের পর তাকে ব্যাংককে নিয়ে যাওয়ার কথা। তার বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার কথা। কিন্তু কারা তাকে ধরে নিয়ে গেল কিছুই জানতে পারছেন না তারা। দিতে পারছেন না প্রয়োজনীয় ওষুধও। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন, জাহিদুল ইসলাম সোহেল নামে কাউকে তারা গ্রেপ্তার বা আটক করেননি। মগবাজারের ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় সোহেল খান নামে একজনকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। নিখোঁজ সোহেলকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
সোহেলের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার সাথী জানান, গত ২৮শে আগস্ট সকাল সাড়ে ১১টায় বাড্ডায় তার স্ত্রীর বড় বোনের বাসা থেকে সাদা পোশাকে তিন ব্যক্তি সোহেলকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে সোহেলের স্ত্রীর বড় বোন বৃষ্টি জানান, তিনজন বাসায় ঢুকেই সোহেলকে খুঁজতে থাকে। এ সময় হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তাদের গাড়িতে ওঠার কথা বলে। সোহেল তাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা সোহেলকে চড় মারে। বৃষ্টি তখন জানতে চান আপনারা কে, সে অসুস্থ, তাকে মারছেন কেন? তখন তাদের একজন পিস্তল দেখিয়ে বলে, আমরা প্রশাসনের লোক। বেশি কথা বললে গুলি করে দেবো। বৃষ্টি ও সাথী জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দেয়া ওই তিন ব্যক্তির সঙ্গে এ সময় মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করার যন্ত্র ছিল। তারা বাড়ির ভেতরে ঢোকার সময় দারোয়ানকে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পরীক্ষার জন্য এসেছে বলে জানায়। অপরাধী ধরতে এমন যন্ত্র ডিবি ও র্যাব ব্যবহার করে বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সোহেল নামে কাউকে তারা গ্রেপ্তার করেননি। বৃষ্টি ও সাথী জানান, সোহেলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা একটি কালো নোয়া এবং একটি সাদা গাড়ি নিয়ে এসেছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, একটি গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩৬৪০২ এবং অপর গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩২৫৩২। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাড়ি দু’টির একটি আল-আরাফহ ইসলামী ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ। তবে গাড়ির মালিক কারা তা জানা যায়নি। বৃষ্টি জানান, প্রশাসনের লোক পরিচয়দানকারীরা সবাই সুঠাম দেহের অধিকারী। তাদের চুল ছোট করে ছাঁটা। বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছর হবে। পরনে টি-শার্ট ও প্যান্ট। এদের কয়েকজন বাসার ভেতরে ঢুকলেও বাইরে তখন তাদের প্রায় ৬-৭ জন ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। সোহেলের স্ত্রী তাসলিমা জানান, সোহেল সৌদি আরব প্রবাসী। তার মা-বাবাও সেখানে থাকেন। ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে প্রায় এক বছর আগে তিনি দেশে ফিরেন। ধানমন্ডি গ্রিন রোডের গ্রিনভিউ ক্লিনিকের চিকিৎসক প্রফেসর এবিএম ইউনুসের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছিল তার। কয়েক মাসের মধ্যে সিঙ্গাপুরে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানোর কথা। তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। এমনকি তার বিরুদ্ধে কোন মামলা বা জিডি নেই। কি কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে এ বিষয়ে নিশ্চিত নন তারা। সূত্র জানায়, সোহেলের মগবাজারের বাসার পাশে সংঘটিত হয়েছে ট্রিপল মার্ডার। ওই মামলার আসামি ফারুক হোসেনের ছোট ভাই অপু ঘটনার পর সোহেলের মোবাইল ফোনে একবার কল দিয়েছিল। অপু পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য তার স্বামীর কাছে সাহায্য চেয়েছিল বলে স্ত্রী তাসলিমা জানান। সোহেলের স্ত্রী তাসলিমার ধারণা, মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণেই ফোন ট্র্যাকিং করে হয়তো সোহেলকে ‘প্রশাসনের লোকজন’ ধরে নিয়ে গেছে। তবে অপুর সঙ্গে সোহেলের ঘনিষ্ঠ কোন সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেন তিনি। পাশাপাশি বাসা আর পাড়ার গলিতে অপু টেলিকম নামে অপুর ফ্লেক্সিলোডের একটি দোকান রয়েছে। ওই দোকান থেকে মোবাইল ফোনে লোড করার কারণেই অপুর সঙ্গে সোহেলের পরিচয়। এর চেয়ে বেশি সম্পর্ক নেই বলে তাসলিমার দাবি। তাসলিমা জানান, রাইয়ান ইসলাম নামে তাদের আড়াই বছরের এক কন্যাশিশু রয়েছে। তাসলিমা বলেন, সোহেল কোন অপরাধ করে থাকলে তার বিচার হবে। তার খোঁজ অন্তত আমাদের দেয়া হোক। সে কোথায় আছে আমাদের জানানো হোক। আমরা তাকে ওষুধটা যেন অন্তত দিতে পারি সে ব্যবস্থা করে দিন ।