বহুল আলোচিত ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪’ তড়িঘড়ি পাসের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মনে করে সংসদীয় কমিটি। কমিটির বেশির ভাগ সদস্য পাসের আগে বিলের ওপর বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ ও বিস্তারিত আলোচনার পক্ষে। কিন্তু সরকার চায় বিশেষজ্ঞদের মতামত ছাড়াই বিলটি পাস করতে। গতকাল সংসদীয় কমিটির বৈঠকে কমিটি বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণের প্রস্তাব করলে বৈঠকে উপস্থিত আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একদিনের সময় নিয়েছেন। সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি আজ বুধবার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে মতামত দেবেন বলে কমিটিকে জানিয়েছেন। এদিকে জাতীয় সংসদ ভবনে কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিলের প্রস্তাবনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কমিটির সদস্যরা। এটাকে ‘অহেতুক’ বলে মন্তব্য করেছেন তারা। এছাড়াও তারা বিলে একাধিক ভুলের কথা তুলে ধরে মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে দ্রুত এ সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়ণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ আইনে বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিটিতে বিচারকদের পাশাপাশি অন্যদেরও প্রতিনিধিত্ব রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, এতদিন বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতেন বিচারকরাই। নতুন আইন হলে এখন সেখানে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতিনিধিত্ব রাখার উদ্যোগ নেয়া হবে। আইনেই এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা থাকবে। তিনি বলেন, এই বিল পাস হলেই কোন বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। অভিযোগ তদন্তের জন্য নতুন আইন করতে হবে। এই বিল পাসের পাশাপাশি দ্রুত সেই আইন পাসের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারকে বলা হয়েছে। বিলটি নিয়ে হায় হায় করার কিছু নেই দাবি করে তিনি বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ ’৭৫ সাল পর্যন্ত বহাল থাকলেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই। আর সকল বিচারপতির অপসারণ হবে না। শুধুমাত্র যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দায়িত্বশীল, সংশ্লিষ্ট ও প্রাসঙ্গিক লোকদের দিয়ে অভিযোগ তদন্ত করা হবে- যা নতুন আইনে নির্দিষ্ট করা হবে। সেখানে অসদাচরণ ও অসমর্থের ব্যাখ্যা থাকবে। বিলের ওপর বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমিটি মনে করে বিলের ওপর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে হবে। মন্ত্রীকে বিষয়টি বলার পর মন্ত্রী এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে জানাবেন বলে জানিয়েছেন। সরকার চাইলে মতামত নেয়া হবে। বিল পাসের মাধ্যমে সংসদ একক ক্ষমতা পাচ্ছে- এমন সমালোচনার জবাবে কমিটির সভাপতি বলেন, বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে যাচ্ছে না। তাদের নিয়োগ ও অপসারণ দু’টিই করবেন প্রেসিডেন্ট। সংসদ নিমিত্তের ভাগী। তদন্ত করে যাদের ধরে এনে দেবে, তাদেরও অপসারণ সংসদ অনুমোদন করতে পারবে। তবে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে। এরপর প্রেসিডেন্ট অপসারণের সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আরও বলেন, দোষী প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত (বিচারপতি) পদত্যাগ করতে পারবেন। আমাদের কিছু করণীয় থাকবে না।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বিলটি নিয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এটা করছেন। তাদের অনেকে বুঝে এবং অনেকে না বুঝে করছেন। বেশির ভাগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে করেছে। কিন্তু এখানে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। তিনি বলেন, আমরাও বিলের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছি। এখানে অযথা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকারের নিয়ে কথা বলেছি। এরা তো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। আমরা আলোচনা করছি সুপ্রিমকোর্টের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা বিচারপতি নিয়ে। এখানে অভিশংসনের কোন বিষয়ই নেই। এখানে দু’টি শব্দ আছে তাকে পদত্যাগ ও অপসারণ। তা-ও কাদের জন্য হবে? মুষ্টিমেয় দুই একজন। সকল বিচারপতির জন্য তো এই প্রসঙ্গ আসেই না। তিনি আরও বলেন, বিচারবিভাগ আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। এখানে আমাদের সবাইকে যেতে হবে। এটা খুবই সাবধানতার সঙ্গে, সকলের স্বার্থে, জনমনের আস্থাভাজন রাখতে হবে ও মর্যাদাও অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। এই বিলটি পাসের মাধ্যমে আমরা সেই কাজটিই করতে চাই। সূত্র জানায়, আজ বেলা সাড়ে ১১টায় আবারও কমিটি বৈঠকে বসবে। গতকালের বৈঠকে কমিটির সদস্য আইন মন্ত্রী আনিসুল হক, মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুল মতিন খসরু, বেগম সাহারা খাতুন, মো. শামসুল হক টুকু, তালুকদার মো. ইউনুস, এডভোকেট মো. জিয়াউল হক মৃধা ও সফুরা বেগম উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতিদের সরানোর ক্ষমতা আইনসভার হাতে ফিরিয়ে আনতে সংবিধান সংশোধনের বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদীয় কমিটিতে রয়েছে। বৈঠকে এই নিয়ে আলোচনার পর কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, অপসারণ ও অভিশংসনকে এখানে একাকার করে ফেলেছে। স্বার্থান্বেষী মহল এমনভাবে অপপ্রচার করছে যাতে মনে হচ্ছে সরকার কোর্টকে নিয়ন্ত্রণ করতেই আইন করছে। কিছু দায়িত্বশীল ও অভিজ্ঞ নেতাও এতে যোগ দিয়েছে।