‘ফেসবুকে ছবি দেইখা মনে হইছে আমার বাচ্চারে আমি এহনই নিয়া আহি। মন চাইছে আমার মানিকরে বুকের লগে জড়াইয়া ধরি। তারপর এইহানে আইসা আমার বাচ্চারে পাইছি।’ দীর্ঘ দুই বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ফিরে পেয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন তার মা পারুল বেগম। গতকাল পারুল ও তার স্বামী হোসেন আলী ফিরে পান তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তান রিফাতকে। দুই বছর আগে গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদনগরের ভাড়া বাসা থেকে হারিয়ে যায় রিফাত। তখন তার বয়স ছিল চার বছর। মা-বাবাহীন দু’টি বছর রিফাতকে সহ্য করতে হয়েছে অমানবিক নির্যাতন। রিফাত জানিয়েছে, তাকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হতো। কথা না শুনলে মারধর করা হতো। খুন্তি গরম করে ছঁ্যাঁকা দেয়া হতো। রিফাতের শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ছ্যাঁকার কালো দাগ। এরশাদনগরের সাত নম্বর ব্লকের ভাড়া বাসা থেকে ২০১২ সালের ৪ই আগস্ট সকাল ৯টায় হারিয়ে যায় রিফাত। রিফাতের মা পারুল জানান, ছেলেকে ভাত দিয়ে ঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে যান তিনি। পারুল তখন রিফাতকে বলেছিলেন ‘বাবা ভাত খাও, আমি আহি।’ প্রায় আধঘন্টা পরে ছেলের খোঁজ করলে তাকে আর পাননি। আশপাশে অনেক খুঁজেছেন। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরাও খোঁজ করেছেন রিফাতের। ১১ই আগস্ট টঙ্গী থানায় একটি জিডি করেন তার পিতা হোসেন আলী। কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। ছুটে গেছেন জ্যোতিষীর কাছে। কিন্তু কেউ তার হারানো সন্তানের খোঁজ দিতে পারেননি। ছেলেকে কিভাবে খুঁজে পেলেন জানতে চাইলে পারুল বেগম জানান, তাদের প্রতিবেশী এক যুবক মোবাইলফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ফেসবুকে ওই যুবকের একটি একাউন্ট রয়েছে। ওই যুবক গত বৃহস্পতিবার ফেসবুকে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের পেইজে রিফাতের ছবিসহ একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পায়। এতে লেখা ছিল, কোন ব্যক্তি ছেলেটির অভিভাবকের সন্ধান পেলে তেজগাঁও থানা সংলগ্ন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হচ্ছে। নিচে সাপোর্ট সেন্টারের ডিউটি অফিসারের ফোন নম্বর দেয়া ছিল। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে রিফাতের মা-বাবাকে জানায় ওই যুবক। কম্পিউটারে ফেসবুক ওপেন করে ছবি দেখায় রিফাতের মা-বাবাকে। ওই দিন রাত ৮টায় তারা ছুটে যান তেজগাঁওয়ে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। ছেলেকে দেখে জড়িয়ে ধরতে যান পারুল। কিন্তু রিফাত তার মাকে চিনতে পারে না। সে দূরে সরে যায়। গতকাল উপ-পুলিশ কমিশনার শামীমা বেগমের কাছে জিডির কপি, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে উপস্থিত হন হোসেন আলী ও পারুল বেগম। প্রায় এক ঘণ্টা পরেই রিফাত তার মা পারুলকে চিনতে পারে। রিফাত জানতে চায়, খালামণি, ভাই কেমন আছে। পারুল জানান, চার বছর পর্যন্ত রিফাত তার খালার কাছাকাছি ছিল। খালাতো ভাই সোহানের সঙ্গে খেলাধুলা করতো। এ সবই মনে পড়ছে তার। গতকাল বিকালে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পারুলের কোলে বসে কথা বলে রিফাত। এ সময় হোসেন-পারুল দম্পতির এক বছর বয়সী সানা উল্লাহও পারুলের কোলে ছিল। রিফাতের শরীরে কালো দাগ, কোথাও কোথাও ফোসকা পড়ে আছে। জানতে চাইলে সে জানায়, আগে সে যেখানে ছিল সেখানে তাকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হতো। ভিক্ষা করতে না চাইলে মারধর করা হতো। খুন্তি গরম করে তাকে ছ্যাঁকা দেয়া হতো। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কর্তব্যরত কর্মকর্তা ফেরদৌসী জানান, গত মঙ্গলবার শিখর পরিবহনের একটি বাসে মিরপুরে ঘুমিয়েছিল রিফাত। এসময় কয়েকজন যাত্রী রিফাতের পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সে মা-বাবা ও নিজের নাম বলতে পারলেও বাসার ঠিকানা বলতে পারেনি। পরে যাত্রীরা মিরপুর ১০-এর ট্রাফিক সার্জেন্ট আসিফ ইকবালের কাছে রিফাতকে হস্তান্তর করেন। পরদিন পুলিশ তাকে নিরাপদ হেফাজতে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়। এখানে তার আলোকচিত্র ধারণ করে ডিএমপি’র ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। কিন্তু তার আগে সে কোথায় ছিল, এ সম্পর্কে রিফাতের বর্ণনা অনুসারে গতকাল সকালে পুলিশ খুঁজে বের করে তার আশ্রয়দাতাকে। তিনি পরিবহন শ্রমিক মঞ্জুর আলম (২৩)। মিরপুরের রূপনগরের দুয়ারীপাড়ার ৩৯ নম্বর সড়কের ১০১ নম্বর বাসার বাসিন্দা। মঞ্জুর আলম জানান, দু্ই বছর আগে আজিমপুর-দুয়ারিপাড়ায় রোডের একটি বাসে রিফাতকে পান তিনি। তারপর থেকে তার বড় বোন নার্গিসের কাছেই ছিল সে। নার্গিস তাকে সন্তানের মতোই লালন-পালন করতেন বলে জানান মঞ্জুর। ভিক্ষা করানো ও মারধর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রায় দেড় মাস আগে রিফাত তাদের বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তারপর কোথায় ছিল, কি করেছে তা তিনি জানেন না। পরিচয়হীন শিশুকে পেয়ে পুলিশকে তা জানাননি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমার ধারণা ছিল না। উপ-পুলিশ কমিশনার শামীমা বেগম জানিয়েছেন, আইনি প্রক্রিয়া শেষে আজ রিফাতকে তার মা-বাবার কাছে তুলে দেয়া হবে।