মিয়ানমারের সরকার অর্থনীতি উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে। আমদানিও শুরু হয়েছে ফোর্ড, জাগুয়ার, বিএমডব্লিউসহ বিশ্বের নামীদামি সব ব্র্যান্ডের মোটর গাড়ি। ফলে এসব গাড়ি এখন কিনতে পারছেন দেশটির মানুষ। অথচ বছর তিনেক আগেও সে দেশে এই গাড়িগুলো কিনতে পাওয়া যেত না।
তবে আমদানি শুরু হওয়া এসব গাড়ি নিয়ে সম্প্রতি অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছে দেশটি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশের মতো মিয়ানমারেও ট্রাফিকব্যবস্থা প্রধানত ডান দিকনির্ভর। এখানে অধিকাংশ গাড়িতে চালকের আসন ডান দিকে থাকে এবং রাস্তার বাম দিক ধরে গাড়িগুলো চলাচল করে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে অবশ্য ব্যাপারটি ভিন্ন। সেখানে চালকের আসনগুলো থাকে বাম দিকে আর গাড়িগুলোও রাস্তার ডান দিকে চেপে চলে।
ফোর্ড, জাগুয়ারের মতো আমেরিকান ও ইউরোপীয় গাড়ি-নির্মাতারা মিয়ানমারে যে গাড়িগুলো বিক্রি করছেন সেগুলোর চালকের আসন বাম দিকে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় তা দেশটির ট্রাফিকব্যবস্থায় একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, বাম দিকনিয়ন্ত্রিত গাড়ি বিক্রির ফলে দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়বে।
ট্রাফিকব্যবস্থার নিয়ম হলো, একটি দেশে বাম অথবা ডান যেকোনো একদিক ধরে যান চলাচল করতে হয়। গাড়ি রাস্তার কোন দিক ধরে চলবে এর সঙ্গে অনেক রাজনৈতিক ব্যাপার জড়িত থাকায় এই সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মিয়ানমারে গত ৫০ বছরের সামরিক শাসনকালে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার গাড়িনির্মাতাদের তৈরি গাড়িগুলো আসেনি। এই সময়ে দেশটিতে মূলত এশিয়ার জাপান ও থাইল্যান্ডে তৈরি গাড়ি বিক্রি ও ব্যবহৃত হয়েছে। এসব গাড়িতে চালকের আসন ডান দিকনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সামরিক শাসকেরা ডান দিকনির্ভর ট্রাফিকব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
২০১১ সালে সামরিক শাসনের অবসানের পরে দেশটিতে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার গাড়ি-নির্মাতারাও মিয়ানমারের বাজারে গাড়ি বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু এই গাড়িই এখন দেশটির বড় ট্রাফিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ফোর্ডের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড ওয়েস্টারম্যান বলেন, ‘আমি মনে করি নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলে এটি সঠিক পদক্ষেপ। আমরা বাম দিকচালিত গাড়ির বাজার তৈরিতে চেষ্টা করছি।’
মিয়ানমারের নাগরিক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক মো থুজার বলেন, এটি সরকারের নীতি সমন্বয়হীনতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হঠাৎ বাম দিকনিয়ন্ত্রিত গাড়ির ব্যবহার ও বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, এমন সিদ্ধান্ত নিলে তা আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু ফোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ধরনের পদক্ষেপ স্বাভাবিকভাবে ভালো চোখে দেখছেন না মিয়ানমারের অন্য গাড়ি আমদানিকারকেরা, যাঁরা ডান দিকনিয়ন্ত্রিত গাড়ি বিক্রি করেন। কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, বাম দিকচালিত গাড়িগুলোর দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার চেয়ে বেশি। বর্তমানের উচ্চ প্রবৃদ্ধির পরও মিয়ানমারের মাথাপছিু আয় এক হাজার ডলারের কম।
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অং তুন থে বলেন, গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে ক্রয়ক্ষমতা অবশ্যই একটি বড় বিষয়। একটি মধ্যবিত্ত পরিবার এখন একটি গাড়ি কেনার কথা চিন্তা করতে পারে, যা কিছুদিন আগেও কল্পনা করা কষ্টকর ছিল।
ডান-বামের এই ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের ব্যাপারে দেশটির বর্তমান বেসামরিক প্রশাসন অবগত থাকলেও এটি সমাধানে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। চালকের আসন বাম দিকনিয়ন্ত্রিত এমন গাড়ির পক্ষে সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে দেশটির অধিকাংশ গাড়িই রাস্তায় চলতে পারবে না। তাই এখন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর প্রভাব পড়তে পারে আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনে। এমনিতে নানা সমস্যায় আক্রান্ত বর্তমান সরকারের এমন সিদ্ধান্ত আগের সামরিক শাসনকে ফিরিয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন অনেকেই।