আসলে হীরক রাজার যন্তরমন্তরে ঢুকিয়ে কানে পড়িয়ে দেওয়া সেই ফুসমন্তরটাই সত্যি। জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই! অন্তত বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বেলায়!
আগের টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে লড়াইয়ের প্রত্যয়। সেখান থেকে প্রেরণা নেওয়ার পর দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১০০তেই যায় যায় অবস্থা! শেষ পর্যন্ত ৭ উইকেটে ৮৯ থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ১০৪ রানে দিন শেষ করা।
অধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে সেই আশ্চর্যরকমের ধারাবাহিকতা। ব্যর্থতার পৌনঃপুনিকতা। ১০ বছর আগে সেন্ট ভিনসেন্ট টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৪৬০ রান করেছিল বাংলাদেশ। ১০ বছর পর একই ভেন্যুতে দুই ইনিংস মিলিয়ে বাংলাদেশ করেছে ৪৯৬। ১০ বছর আগে বাংলাদেশের ক্রিকেট যেখানে ছিল সেখানেই আছে—এই মন্তব্য করবেন না, প্লিজ।
১০ বছর আগে সেন্ট লুসিয়ায় প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ করেছিল ৪১৬। আর কাল বাংলাদেশ যেভাবে নার্সারিপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাংয়ের এ-বি-সি-ডি লেখার মতো ব্যাটিংটা করল, কে জানে, টেস্টের ২০০ বছরের পুরোনো নিয়ম ভেঙে এই মাঠে বাংলাদেশকে চারবার নামিয়ে দেওয়া হলেও ৪০০ করতে পারে কি না—সন্দেহ।
১৪ বছর আগে বাংলাদেশের ক্রিকেট যেখানে ছিল, দৃশ্যত কখনো কখনো মনে হয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট যেন আরও পিছিয়েছে! নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার মতো কিছু ‘বিচ্ছিন্ন’ সাফল্যের ছেলে ভোলানো ছড়ায় আপনি ভুলতে পারেন, কিন্তু এক পা এগোলে বাংলাদেশ যেন দশ পা পিছিয়েও যায়। টেস্টে তো সেটি আরও ভীষণ সত্যি। যেন ক্রিকেট নয়, বাংলাদেশ দল সাপলুডু খেলছে!
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের ১৪ বছরকে দুই ভাগে যদি ভাগ করেন, ১০০-এর নিচে বাংলাদেশ অলআউট হয়েছে আটবার। চারবারই গত সাত বছরে। সবচেয়ে হতাশার কথা হলো, বাংলাদেশের সর্বনিম্ন চারটি ইনিংসের দুটোই এই সময়ে। ১৫০-এর নিচে বাংলাদেশ অলআউট হয়েছে ৩৬ বার। এর মধ্যে ১৩ বারই গত সাত বছরে। এই তবে উন্নতির নমুনা?
কালকের কথাই ধরুন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৯ নম্বর ‘ব্যাটসম্যান’টি কাল ৪০ রান করলেন। সেখানে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত ব্যাটিং করা নয় ব্যাটসম্যানের মধ্যে সর্বোচ্চ তামিম ইকবালের—৪৮। দশে নেমে সুলিমান বেন পর্যন্ত ২৫ রান করে গেছেন। টেলর আর বেনের ব্যাটিংটাও এমন সময়ে, যখন বাংলাদেশি বোলাররাই এগিয়ে ছিলেন। ১৮ রানের মধ্যে তুলে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। টেলর আর বেনের মতো টেলএন্ডারদের নিয়ে অষ্টম ও নবম উইকেটে দুটো ফিফটি জুটি গড়েছেন শিবনারায়ণ চন্দরপল। সেখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটিটাই ২৯ রানের।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিমান ধরার আগে মুশফিকুর রহিম একটা মন্তব্য করেছিলেন। টেস্ট খেলার আগে বাংলাদেশ তিনটি ওয়ানডে আর একটা টি-টোয়েন্টি খেলবে। খেলবে দুটো প্রস্তুতি ম্যাচও। ফলে টেস্টের আগে কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। এই হলো কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার নমুনা। কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গত মে মাসে পাঠানো হয়েছিল ‘এ’ দলকে। সেই দলের অধিনায়ক নাসির হোসেন এবারের আসল সফরে টেস্ট-ওয়ানডে মিলিয়ে ৬ ইনিংসে করেছেন ৮০ রান।
বাংলাদেশের ক্রিকেট কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে ব্যাটসম্যানরা আসলে কোথায় পড়ে আছেন, সেটার ভালো উদাহরণ হয়ে থাকল ইনিংসের ৩৫তম ওভার এবং তাইজুল ইসলাম। কেমার রোচের একের পর এক শর্ট বলে তাইজুল নাকানি-চুবানি খেতে খেতে শেষে ক্যাচ দিয়ে বাঁচলেন। রবীন্দ্রনাথ হলে লিখতেন, ব্যাটসম্যান তাইজুল মরিয়াই বাঁচিয়া গেল!
ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে একটা ফিফটি থাকলেও কাল ৮ নম্বরে নামা তাইজুলকে উদাহরণ হিসেবে টানা হয়তো বেখাপ্পা ঠেকতে পারে। কিন্তু শুরুতে ইনিংসের হাল ধরা শামসুর রহমান, যিনি নিজেও ‘এ’ দলের হয়ে এই কন্ডিশনে শিক্ষাসফর করে গেছেন, সেই তিনিও কোমর কিংবা আর একটু উচ্চতায় ধেয়ে আসা বাউন্সারগুলোকে সাপের ফণার মতোই ভয় পেয়ে গেলেন পুরো টেস্ট সিরিজে, বিশেষ করে রোচকে।
রোচ আরও একবার ৫ উইকেট তুলে নিলেন। ৮৭ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলার পরও ১০০-এর নিচে অলআউট না হওয়াটাই বোধ হয় কাল বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের একমাত্র সফলতা।
এই তথ্যে তাই কোনো বিস্ময় নেই, যে ৩৬ বার বাংলাদেশ ১৫০-এর নিচে অলআউট হয়েছে, এর ২২ বারই বিদেশের মাটিতে। ১৪ বার ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে, যেখানে উইকেট গতিশীল। গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ একটু পেস সহায়ক উইকেটে খেলার অভ্যাস এখনো গড়ে তুলতে পারেনি। একটু বাড়তি পেস আর বাউন্স মানেই কাঁপাকাঁপি। কারণটা সেই বহুল চর্চিত—এই দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের ঘুমপাড়ানি মন্থর উইকেট। কঠোর প্রশিক্ষণ মানে সহজ যুদ্ধ। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বেলায় সেটি সহজ প্রশিক্ষণ আর কঠোরতম যুদ্ধ।
সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন উত্তরসূরিদের বরাবরই স্নেহের আঁচল দিয়ে আড়াল করে বিসিবিকে দোষেণ এবং নিজের কাঁধেও দায় নেন। কিন্তু ‘দীন-দুখিনী’ বিসিবির এর চেয়ে বেশি সাধ্য যদি না-ই থাকে, নিজের চেষ্টার জায়গাটায় তো আরও বেশি ঘাম ঝরাতে হবে। সে কথাও তিনি মনে করিয়ে দেন মুশফিকদের। খেলোয়াড়দের অনেকের মধ্যেই সেই বাড়তি শ্রম ঝরানোর তাগিদটার অভাব তিনি সব সময়ই দেখেন।
হ্যাঁ, জানার কোনো শেষ নাই। এ কারণেই তো চেষ্টার, পরিশ্রমের, নিষ্ঠার, একাগ্রতারও কোনো শেষ নাই!