বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী যেদিন দিল্লি এলেন, গোটা রাজধানী সেদিন প্রায় অচল। শহরের মূল রাস্তাগুলোয় ইঞ্চি ইঞ্চি করে গাড়ি চলেছে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত। দিল্লি আর যা-ই হোক ঢাকা নয়। ঢাকার মতো যানজট এই শহরে প্রাত্যহিক শিরঃপীড়ার কারণও হয় না। কিন্তু চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আগমন ও দিল্লি পুলিশের অতি সাবধানতা গোটা রাজধানীকে অচল করে দেয়। জিনপিংয়ের প্রবল উপস্থিতি সত্ত্বেও সেই যানজট কাটিয়ে মাহমুদ আলী পরের দিন নয় নয় করে ছয়জন গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় নেতার সঙ্গে পরিচিত হলেন। একমাত্র রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ছাড়া বাকি সবার সঙ্গেই এই তাঁর প্রথম আলাপ। সেই প্রথম মানুষের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ছিলেন।
গোটা ভারত, ভারতের সদা জাগ্রত মিডিয়া চীনা প্রেসিডেন্টের সফর নিয়ে এতটাই মোহাবিষ্ট ছিল যে মাহমুদ আলীর দিল্লি আগমন প্রায় নিঃশব্দে ঘটে যায়। এই রকমের আদিখ্যেতা অবশ্য ভারতীয় মিডিয়া ও রাজনীতিকদের একটা পুরোনো ব্যাধি। পাকিস্তানকে নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া সব সময়ই বাড়াবাড়ি রকমের আদিখ্যেতা দেখিয়ে এসেছে ও আসছে। চীনকে নিয়েও এবার তেমনই হলো। শি জিনপিং ভারতে আসার তিন দিন আগে লাল ফৌজ লাদাখে ভারতীয় জমিতে ঢুকে পড়ল, প্রেসিডেন্ট তাদের সরে যেতে বলা সত্ত্বেও তারা গ্যাঁট হয়ে বসে রইল, এসব অত্যাশ্চর্য ঘটনার ফলে জিনপিংয়ের সফর একটা বাড়তি মাত্রা পেয়ে যায়। তার ওপর মাত্র কদিন আগে মোদির জাপান সফর নিয়ে হইচই হয়ে গেছে, মোদি-আবে মাখামাখি রাষ্ট্র হয়েছে ও ভারতের রাষ্ট্রপতিও ফিরেছেন ভিয়েতনাম সফর করে। জাপান ও ভিয়েতনাম দুই দেশই চীনের চোখের বালি। আদিখ্যেতার সঙ্গে এই বাড়তি ব্যাপারগুলো মাখামাখি হয়ে জিনপিংয়ের সফরকে এক্সট্রা স্পেশাল করে তোলে। ফলে বাংলাদেশ-ভারত তৃতীয় যৌথ সংসদীয় পরামর্শদাতা কমিশনের (জেসিসি) বৈঠককে মিডিয়া কতটা গুরুত্ব দেয়, সেটা দেখার একটা স্বাভাবিক আগ্রহ দানা বেঁধেছিল। দেখা গেল, সরকারি ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও পররাষ্ট্র মন্ত্রক বিশেষ ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করল এবং গোটা জাতীয় গণমাধ্যম সেই খবর পরিবেশন করল। ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব কতখানি এবং বাংলাদেশকে মোদির সরকার কোন চোখে দেখছে, এটা তার একটা ছোট্ট উদাহরণ।
ভারতীয় গণমাধ্যমের একটা বড় অংশ, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমগুলোর আবার এক নম্বর আগ্রহ ছিল সারদা কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারির পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দায়িত্ব ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তুলে দিয়েছেন সিবিআইয়ের ওপর। তারা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের এক রাজ্যসভার সদস্যকে জেরা করে লোমহর্ষক কিছু বিষয় নাকি জানতে পেরেছে। যেমন, সেই সাংসদ নাকি সারদার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা সীমান্তের ওপারে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর হাতে তুলে দিয়েছেন, যাতে শেখ হাসিনার সরকারকে নাকের-জলে-চোখের-জলে করা যায়। জামায়াতের হাত দিয়ে সেই টাকার একটা বিপুল অংশ নাকি পশ্চিম এশিয়ায়ও পাচার হয়েছে। মারাত্মক সব অভিযোগ। সাংসদ যদিও সেসব অস্বীকার করেছেন এবং রাজ্য সরকারের মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন, সেই সাংসদ মুসলমান বলেই বিজেপি এসব আজগুবি কথা রটিয়ে লোক খেপাচ্ছে। যা হোক, এ দেশের খবরের কাগজের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ নাকি এই সংবাদে অতিশয় ক্ষিপ্ত। তারা নাকি ভারতের কাছে সরকারি স্তরে অভিযোগ জানিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছে। এসব শোনা গেলেও এবং কাগজে কাগজে লেখালেখি হলেও কি ভারত কি বাংলাদেশ, কোনো দেশ থেকেই সরকারিভাবে কোনো মন্তব্য শোনা যাচ্ছিল না। মাহমুদ সাহেবের কাছ থেকে এই বিষয়ে কিছু জানতে মিডিয়া তাই উদ্গ্রীব ছিল।
ফলে হলো কী, জেসিসি বৈঠকের ঠিক আগের দিন, যেদিন ছজন নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললেন মাহমুদ সাহেব, সেদিনই তাঁর
হোটেলে আমন্ত্রিত গণমাধ্যমের মোক্ষম প্রশ্নটা ছিল সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে। মাহমুদ সাহেব কিন্তু প্রশ্নটা মোকাবিলা করলেন চমৎকারভাবে। বললেন, ‘ওটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ পরের দিনও জেসিসি বৈঠকের পরে প্রায় সেই একই কথা। বাড়তি সংযোজন, ‘ভারত কখনো বাংলাদেশবিরোধী কোনো কাজে মদদ দেবে না ও বরদাশত করবে না বলে আমাদের আবার আশ্বস্ত করেছে।’ একই দিনে দুই ঘণ্টা আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, কূটনৈতিক আলোচনায় সারদা প্রসঙ্গ ওঠেইনি।
মাহমুদ ও আকবরউদ্দিন এই যে কথাটা বললেন, এটাই হলো কূটনীতিকদের বাচনভঙ্গির শিক্ষা। আকবরউদ্দিন যখন বললেন ‘কূটনৈতিক আলোচনায়’ প্রসঙ্গটি ওঠেনি, তখন তিনি অসত্যভাষণের দায়ে পড়লেন না। কারণ, জেসিসিতে বিষয়টি আলোচিত হয়নি। অর্থাৎ, সরকারি স্তরে বাংলাদেশ বিষয়টি তোলেনি। আবার, মাহমুদ আলী যখন ‘ভারত তাঁদের আবার আশ্বস্ত করেছে’ কথাটা বলেন, তখন বুঝতেই হবে বিষয়টির অবতারণা তাঁরা করেছিলেন, যদিও তা কূটনৈতিক স্তরে নয়। কোন স্তরে তাহলে? উত্তরটা রাজনৈতিক স্তরে হতে পারে। কিংবা তিনি যখন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক করেন, তখন তা তুলেছিলেন। প্রশ্নটা হলো, এত বড় একটা অভিযোগ নিয়ে বাংলাদেশ কেন সরাসরি কোনো ক্ষোভ দেখাল না? নিদেনপক্ষে তারা যে খুবই অসন্তুষ্ট ও চিন্তিত, সরকারিভাবে অন্তত তা জানিয়ে কেন রাখল না? আসলে, তা না করে বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় রাখল। ভারতের বিচারব্যবস্থা ও তদন্তকারী সংস্থার প্রতি ভরসা রাখার পাশাপাশি তারা কোনো বাড়তি চাপও সৃষ্টি করল না। ভারতের কাছ থেকে তাদের চাহিদার তালিকা এই বিচারাধীন বিষয়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সীমান্ত বিল বাস্তবায়ন ও তিস্তা চুক্তি রূপায়ণ রাজনৈতিকভাবে তাদের অনেক বেশি কাম্য। সারদা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের সঙ্গে কূটকচালিতে জড়ানোটা সেই লক্ষ্যে কাঁটা বিছাতে পারে।
মাহমুদ সাহেব প্রথম দিন ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলার পর আমাদের বলেন, ‘অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কথা হয়েছে। আমরা খুবই আনন্দিত। এটাই আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম। সম্পর্ক এমনটাই হওয়া উচিত।’ দ্বিতীয় দিন জেসিসির বৈঠক শেষে উৎফুল্ল মাহমুদ আলী ইংরেজিতে প্রথম যে বাক্যটি বললেন, তা হলো, ‘উই আর অ্যাবসল্যুটলি ডিলাইটেড।’ সংবাদ সম্মেলনে তাঁর দ্বিতীয় বাক্যটি ছিল, ‘ইটস আ বিগ ডিপারচার ফ্রম দ্য পাস্ট।’
মাহমুদ আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। এমএ পাস করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অধ্যাপনা করে ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতাসংগ্রামকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, ’৭১ সালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিত্বও করেছেন। তারপর ‘কেরিয়ার ডিপ্লোম্যাট’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন নিজের জীবন। ২০০১ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ভারত সফরে এসে বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য ও সেসব রক্তঝরা দিনের স্মৃতিচারণার ফাঁকে যখন তিনি নরেন্দ্র মোদির সেই কথাটি শোনেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সেই দেশকে রক্ষা করেছেন’, তখন নিতান্ত আপ্লুত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও তাঁর ছিল না। মাহমুদ আলীর কাছে তাঁর এই সফর তাই অনেকটাই আবেগঘন।
কিন্তু সেই আবেগের গণ্ডির বাইরে তিনি ও ভারতীয় নেতৃত্ব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক অপার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন বলেই মাহমুদ সাহেব ‘ডিলাইটেড’ ও ‘বিগ ডিপারচার’ শব্দ দুটি উচ্চারণ করেছেন। জেসিসির বৈঠক শেষে দুই দেশ যে যুগ্ম বিবৃতি প্রকাশ করে, তার ছত্রে ছত্রে সেই সম্ভাবনা লিপিবদ্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগব্যবস্থা, উন্নয়ন কর্মসূচি ও অন্য বহু বিষয়ে সহযোগিতার যে ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসে ভর দিয়ে দুই দেশ যদি সেগুলোর সার্থক রূপায়ণ করতে পারে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গোটা পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল তাহলে এক বৃহত্তর সোনার বাংলায় বিকশিত হবে। বাংলাদেশের বিদ্যুতের ঘাটতি দূর করা, অবকাঠামো নির্মাণে আরও আর্থিক সহায়তা, বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা কাটানো, মানুষের সঙ্গে মানুষের মেলামেশা বাড়ানো, সর্বস্তরে যোগাযোগ বৃদ্ধি, বছরে ছয় বিলিয়ন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বৃদ্ধিই শুধু ঘটাবে না (যার বেশিটাই এখনো ভারতের অনুকূলে); বাণিজ্যিক অসাম্যও দূর করবে। ভারতীয় শিল্পপতিদের জন্য বাংলাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দেওয়ার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে এবং তার পাশাপাশি উপকূলবর্তী জাহাজ চালানোর পরিকল্পনা (যা কিনা ভারতের চেন্নাই থেকে বাংলাদেশ হয়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সওদাগরিতে সহায়ক হবে), তা কার্যকর হলে সেটাই হয়ে দাঁড়াবে আগামী কয়েক দশকের দুই দেশের আঞ্চলিক অর্থনীতির শক্ত মেরুদণ্ড।
নরেন্দ্র মোদি উন্নয়নের স্বপ্ন ফেরি করে দিল্লির মসনদে বসেছেন। বাংলাদেশকেও তিনি তাঁর স্বপ্নের শরিক করার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি একাধিকবার বলেছেন, প্রতিবেশীদের নিয়েই এগোতে চান। কথায় ও কাজে অসামঞ্জস্যের অভিযোগ এখনো কেউ আনেনি। ক্ষমতায় আসার পর তিনি ও তাঁর সরকারের শীর্ষ নেতারা বারবার তাঁদের ওপর আস্থা রাখার কথা বাংলাদেশের নেতৃত্বকে বলেছেন। যে দুটি বিষয় দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে গলার কাঁটা হিসেবে খচখচ করছে, সেই তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তি নিয়ে অযথা চাপ সৃষ্টি না করে বাংলাদেশও আস্থা ও বিশ্বাসে ভরসা রেখে চলতে চাইছে। শেখ হাসিনার বিচক্ষণ কূটনীতির সঞ্চালক আবুল হাসান মাহমুদ আলী তাই সারদা কেলেঙ্কারিকে ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে পাশ কাটিয়েছেন। তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তি নিয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন। তিন দিনের ভারত সফর শেষে ‘অ্যাবসল্যুটলি ডিলাইটেড’ মাহমুদ আলী দিল্লি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইট ধরেছেন তাঁর প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হতে।