দৃশ্যত রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলেও বিনিয়োগে গুমোট ভাব কাটছে না। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অলস পুঁজি পড়ে আছে। তারল্য বাড়ছেই। দেশের অন্যতম বিনিয়োগ খাত পুঁজিবাজারেও কোন সুখবর নেই। পোশাক খাতে দিনকে দিন রপ্তানি কমছে। জুলাইয়ে এ শিল্পের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। বিদেশী বিনিয়োগেও স্থবির। বিশ্লেষকরা মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা এখনও আস্থা ফিরে পাননি। তারা আরেকটি রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা করছেন। মূলত ২০১৩ সাল থেকেই বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করছেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বাংলাদেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ খাত সম্পর্কে মানবজমিনকে বলেন, সরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ একটা দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, বিশেষ করে গত নির্বাচনের আগে ও পরে এ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুতে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু গ্যাসের সমস্যা সমাধান হয়নি। একই সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অবনতি হয়েছে। এ ছাড়া বিনিয়োগের স্থান তথা অর্থনৈতিক জোন নেই। সব মিলিয়ে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। এসব কারণে দেশী বিনিয়োগকারীরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। অন্যদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগকারীদের বিশেষ প্রণোদনা দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের এ প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, উদ্যোক্তাদের সুযোগ-সুবিধা মতো অবকাঠামো উপহার দিতে না পারলে, যত প্রণোদনা দেয়াই হোক, কোন সুফল আসবে না।
ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য: ব্যাংকগুলোতে অঢেল তারল্য। বলা চলে ব্যাংকিং খাতে এখন অলস টাকার পাহাড় জমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। আবার ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্যের কারণে আমানতের সুদ কমছে ধারাবাহিকভাবে। তবে আমানতের সুদ যে হারে কমছে সে হারে কমছে না ঋণের সুদ হার। এতে করে ঋণ ও আমানতের মধ্যে সুদ হারের ব্যবধান (সেপ্রড) বাড়ছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানান, ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা কাটেনি। কারও কাছে টাকার পাহাড়, কেউ চলে ধারে। একদিকে তারল্য ছাড়িয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। অন্যদিকে নগদ টাকার সঙ্কট। জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে যে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে তার বেশির ভাগই সরকারের ঋণ আকারে রয়েছে। বিনিয়োগ স্থবিরতার মধ্যে ব্যাংকগুলো সরকারের বাধ্যতামূলকভাবে ঋণের যোগান দিয়েছে। সরকার তার ঋণের বিপরীতে বন্ড ও বিল নামক ব্যাংকগুলোকে কাগুজে মুদ্রা ধরিয়ে দিয়েছে।
এদিকে ঋণ কেলেঙ্কারির প্রভাবে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে ব্যাংকিং খাত। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ নীতিমালা শিথিলের মধ্যেও খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রভিশন (ঝুঁকিপূর্ণ ঋণে অর্থ সংরক্ষণ) ঘাটতি। কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। এসব ব্যাংক ঋণঝুঁকির বিপরীতে প্রয়োজনীয় অর্থও সংরক্ষণ করতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র মতে, ব্যাংকগুলোতে গত ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে।
বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে: টানা তিনটি অর্থবছর প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ার পর আবার তা কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত অর্থবছর শেষে দেশে মোট প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫৫ কোটি ডলার। আর ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে তা ছিল ১৭৩ কোটি ডলার। এর ফলে তিন অর্থবছর পর বিদেশী বিনিয়োগ আবার কমে গেল।
অবশ্য এ পরিসংখ্যানটি প্রাথমিক প্রাক্কলন। এটি চূড়ান্ত হবে আগামাী জুনের আগে। তথ্য মতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১১৯ কোটি ৪৮ লাখ ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ আসার পর ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ১৭৩ কোটি ডলার। ধারণা করা হয়েছিল, এই ধারাবাহিকতায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাস্তবে তা হয়নি, বরং কিছুটা কমে গেছে। এটা হয়েছে, দেশে গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর, ২০১৩) বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগ পরিস্থিতির ওপর।
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের লেনদেন ভারসাম্য সারণির তথ্য থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ এসেছিল ৮৪ কোটি ডলারের। তবে পরের ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) তা কিছুটা কমে হয় ৭০ কোটি ডলার।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) মনে করে, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য বিদ্যমান সুবিধা ও প্রণোদনাগুলো অব্যাহত রাখলেই হবে না, তা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া উচ্চ সুদের হার ও জটিল করব্যবস্থা বিনিয়োগকে বাধাগস্ত করছে। কাজেই এগুলোকে যৌক্তিক করতে হবে।
পোশাক রপ্তানি কমছেই: চার মাস ধরে তৈরী পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেই চলছে। এ ধারা আগামীতে আরও অব্যাহত থাকবে। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে ৮০ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী সম্ভাবনাময় এ পোশাক শিল্প এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। ফলে আগামীতে এ খাত আরও কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিজিএমইএ’র তথ্যে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের এপ্রিল, মে, জুন ও নতুন অর্থবছরের জুলাই মাস পর্যন্ত তৈরী পোশাক শিল্পের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ক্রমাগতভাবে হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। নতুন অর্থবছর পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি শুরুই হয়েছে বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে, যা লক্ষ্যমাত্রার ধারের কাছেও নেই। চলতি বছরের জুলাই মাসে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ০.৭ শতাংশ। যেখানে গত বছরের একই মাসে রপ্তানি হয়েছিল ২৬.১৩ শতাংশ। অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ রানা প্লাজা ধসেও গত বছর রপ্তানি আয় তার আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১২ শতাংশ বেশি ছিল।
এ ছাড়া নানা সঙ্কটে গত দেড় বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ৩৯৯টি তৈরী পোশাক কারখানা। এর মধ্যে বিজিএমইএভুক্ত কারখানা বন্ধ হয়েছে ২০৭টি কারখানা। আর বিকেএমইএভুক্ত ১৯২টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। কারখানাগুলোতে প্রায় ২ লাখ শ্রমিক কাজ করতেন। রানা প্লাজা দুর্ঘটনা-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্ডার বাতিল, মজুরি বৃদ্ধি, কমপ্লায়েন্স ইস্যু, সাব-কন্ট্রাক্ট ও শেয়ার্ড বিল্ডিংয়ে কাজ না পাওয়ার কারণে এসব কারখানা বন্ধ হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে নতুন বাজারে কিছুটা ভাল করলেও বাংলাদেশের অন্যতম বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে পিছিয়েছে। আর বাংলাদেশকে টপকে সামান্য ওপরে উঠে গেছে ইন্দোনেশিয়া। তবে দ্রুততম গতিতে এগোচ্ছে ভিয়েতনাম। ভারতও এগিয়েছে অনেকটা। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটেক্সা) সমপ্রতি প্রকাশ করা তথ্যে এ হিসাব মিলেছে। ওটেক্সার হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে এখন চতুর্থ অবস্থানে। শতাংশের হিসাবে দাঁড়িয়েছে ৬.৫ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারি শেষে এ অবস্থান ছিল তৃতীয়। জুন শেষে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে ইন্দোনেশিয়া। যার ৬.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বিজিএমইএ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজীম মানবজমিনকে বলেন, রানা প্লাজার পর থেকে এত কারখানা বন্ধের মূল কারণ হলো এ শিল্পের নেতিবাচক প্রভাব। তিনি বলেন, এক বছরে পোশাক খাতে এত কারখানা বন্ধ হওয়া শিল্পের জন্য সুখবর বয়ে আনেনি। এখন বহু শ্রমিক বেকার রয়েছে।
পুঁজিবাজারে সর্বনিম্ন বিদেশী বিনিয়োগ: ২০১০ সালে ভয়াবহ ধসের পর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি দেশের পুুঁজিবাজার। এরই ধারাবাহিকতায় বাজারে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে বিদেশী নিট বিনিয়োগ। চলতি বছরের সদ্য সমাপ্ত আগস্ট মাসে বিদেশী নিট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসের পর সবচেয়ে কম। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, আগস্ট মাসে বিদেশীরা পুুঁজিবাজারে ৩১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করেন। এর মধ্যে বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে তারা শেয়ার কিনেন ১৬৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ আগস্ট মাসে বিদেশী নিট বিনিয়োগ হয় ১২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে শেয়ারবাজারে বিদেশী নিট বিনিয়োগ হয় পাঁচ কোটি দুই লাখ টাকা। এরপর আর কখনও বিদেশী নিট বিনিয়োগ ১৫ কোটি টাকার নিচে নামেনি। আর সর্বশেষ ১৯ মাসের (আগস্ট বাদে) মধ্যে সবচেয়ে কম বিদেশী নিট বিনিয়োগ হয়েছে ৫৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। ডিএসই’র বিদেশী বিনিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে বিদেশী নিট বিনিয়োগ ছিল ১৯৪৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। বছরটিতে গড়ে প্রতি মাসে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৬১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। চলতি বছরের শুরুর দিকেও বিদেশী বিনিয়োগের ওই ধারা অব্যাহত ছিল। বছরের প্রথম মাসেই (জানুয়ারি) বিদেশী নিট বিনিয়োগ হয় ২৭৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। মাসটিতে বিদেশীরা বাজারে ৫২৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করেন। এরপর জুলাই মাস শেষে বিদেশী নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। মাসটিতে বিদেশীরা মোট লেনদেন করেন ২৫৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। বিদেশী বিনিয়োগ কমার এ ধারা সদ্য সমাপ্ত আগস্ট মাসেও অব্যাহত ছিল। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্মকর্তা বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ দিয়ে কখনও সার্বিক বাজার পর্যালোচনা করা যায় না। তবে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সুযোগ বুঝে তথ্য পর্যালোচনা করে বিনিয়োগ করে থাকেন। সুযোগ মতো শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে তারা বাজার থেকে লাভ নিয়ে বেরিয়ে যান। এদিকে এসবের মধ্যেও থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার আদলে বাংলাদেশ সরকার ও বিনিয়োগকারীদের বিশেষ প্রণোদনা দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য এ প্রণোদনা ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু দেশে অবকাঠামো বা গ্যাস-বিদ্যুতের যে অবস্থা তাতে কি বিশেষ প্রণোদনা দিয়েও বিনিয়োগ আনা যাবে- এমন প্রশ্ন অর্থনীতিবিদদের।