‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে ভাই’—বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে অবৈধ অ্যাকশনের বোলারের সংখ্যা আন্দাজ করতে বলায় এমন উত্তরই দিলেন ক্রিকেট সংগঠক আলী আসাফ। সেই সঙ্গে সাফ জানিয়ে দিলেন, দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে ‘চাকিং’ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোহাগ গাজী ও আল-আমিন হোসেনের মতো আরও ক্রিকেটারের কপালে দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে।
ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিটি ক্লাবেই খোঁজ নিলে দু-একজন চাকারের সন্ধান মিলবে বলে জানালেন এই সংগঠক। কেবল আসাফ নন, ঘরোয়া লিগে নিয়মিত চোখ রাখেন এমন যে-কেউই ব্যাপারটা স্বীকার করবেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তো চাকার আছেই, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটে এই সংখ্যা ভয়াবহ পর্যায়েই। ওই পর্যায়ে চাকারের সংখ্যা নিরূপণে ওই ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার প্রবচনটি দারুণভাবেই খেটে যায়।
ঘরোয়া ক্রিকেটে চাকিং মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লেও এটি ঠেকানোর ব্যাপারে আপাতদৃষ্টিতে দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা বিসিবির কোনো উদ্যোগ নেই বলেই জানালেন অনেকে। আলী আসাফ বলেন, একটা সময় বিসিবির এ-সংক্রান্ত একটি পর্যালোচনা কমিটি থাকলেও তিন-চার বছর ধরে এই পর্যালোচনা কমিটির কোনো কার্যক্রম নেই। কোনো পর্যবেক্ষক বা নিয়ন্ত্রক না থাকায় ঘরোয়া ক্রিকেটে চাকারের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
অনেক সময় বিভিন্ন প্রভাবশালী ক্লাবের চাপেও ‘চাকার’দের দেখেও না দেখার ভান করা হয় বলে অভিযোগ আছে। অবৈধ অ্যাকশনের বোলারটি যদি বড় কোনো ক্লাবের হন, তাহলে তো তাঁর পোয়াবারো। রীতিমতো বল ছুড়েই ওই প্রভাবশালী ক্লাবকে ভালো ফল উপহার দেন অবৈধ অ্যাকশনের ওই বোলার। ব্যাপারটা এতটাই উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে যে এ ব্যাপারে এখন আর কোনো রাখঢাকের ধার ধারেন না কেউই।
ক্রিকেট সংগঠক ও বিসিবির পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি মনে করেন ক্রিকেটীয় চেতনার বাইরে গিয়ে সবাই অতিমাত্রায় ফল-নির্ভর হয়ে যাওয়ার কারণেই ঘরোয়া ক্রিকেটে চাকিংয়ের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় সংগঠকেরা একজন বোলারের অবৈধ অ্যাকশন দেখেও না দেখার ভান করেন। এভাবে চলতে চলতে পুরো বিষয়টিই ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করেছে।’
টেপ-টেনিস ক্রিকেটের অতিপ্রচলনও অবৈধ অ্যাকশনের বোলার তৈরিতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন ববি, ‘আমাদের দেশে ছেলেদের ক্রিকেটে হাতেখড়িই হয় টেপ-টেনিস ক্রিকেটের মধ্য দিয়ে। এই টেপ-টেনিসে জোরে বোলিং করতে কিছুটা চাকিংয়ের সহায়তা নিতেই হয়। এরাই যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে আসে, তখন তাদের মধ্যে ওই অভ্যেসটা থেকেই যায়। পাকিস্তানেও টেপ-টেনিস ক্রিকেটের খুব প্রচলন। সেখানেও বাংলাদেশের মতো চাকিং ভয়াবহ মাত্রা পেয়েছে। বাজে-নিচু উইকেটে ঘরোয়া ক্রিকেটও ঘরোয়া ক্রিকেটে চাকারের জন্ম দিচ্ছে।’
জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুও শঙ্কিত ঘরোয়া ক্রিকেটে চাকারের আধিক্যে। তিনি বলেন, সঠিক সংখ্যা হয়তো বলা সম্ভব নয়, কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে চাকারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। নিচের স্তরে নিয়ন্ত্রক ও পর্যবেক্ষকের অভাবে এই সংখ্যা অনেক বেশিই হবে।
চাকার নিয়ন্ত্রণে বোর্ডের পর্যালোচনা কমিটির অস্তিত্ব এখন আর নেই বলেই জানালেন গাজী আশরাফ। আইনে বোলারের কনুই ভাঙার নির্দিষ্ট মাত্রা ৮ ডিগ্রি থেকে বেড়ে ১৫ ডিগ্রি হওয়ার পরপরই এই পর্যালোচনা কমিটি ঝিমিয়ে পড়ে। এটা এখন বিলুপ্তই বলা চলে।
পর্যালোচনা কমিটি ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। এই কমিটির প্রধান কাজ ছিল জাতীয় ক্রিকেট লিগ ও ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে অবৈধ অ্যাকশনের বোলার খুঁজে বের করা। তারা এই ধরনের বোলারদের একটি তালিকা করে ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিসের (সিসিডিএম) মাধ্যমে তা বোর্ডে পাঠাত। তালিকায় থাকা খেলোয়াড়দের অ্যাকশন শুধরাতে ওই সময় কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চার বছর ধরেই এ ধরনের কোনো কার্যক্রমেই মনোযোগী নন ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টরা।
সোহাগ গাজী ও আল-আমিন হোসেনের মতো দেশের আর কোনো বোলারকে যেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নাজেহাল না হতে হয়, সে ব্যাপারে বোর্ডের পদক্ষেপটা খুব দ্রুতই নেওয়া উচিত বলে মনে করেন গাজী আশরাফ হোসেন। তিনি বলেন, সোহাগ ও আল-আমিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে রিপোর্টেড হওয়ার হওয়ার পর বেশ কিছু দিন চলে গেল, কিন্তু বোর্ডের তরফ থেকে ব্যাপারটি নিয়ে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ল না। দেশের আর কোনো বোলার যেন এই সমস্যায় না পড়ে, সে জন্য বাস্তবিক উদ্যোগটা দ্রুতই নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল।
বোলারের অবৈধ অ্যাকশন ধরতে একসময় মাঠে তিন-চারটি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন গাজী আশরাফ। কিন্তু সেটাও পরে আর বাস্তবায়িত হয়নি, ‘একটা সময় মাঠে ক্যামেরা বসানোর কথা ছিল। ক্যামেরা থাকলে আম্পায়াররা বা অন্যরা খুব সহজেই অবৈধ অ্যাকশনের বোলারকে খুঁজে বের করতে পারত। ঠিক আছে, উদ্যোগটা তখন নেওয়া হয়নি, কিন্তু সোহাগ ও আল-আমিনের পর এ বিষয়ে খুব দ্রুতই পদক্ষেপ নিয়ে নেওয়া দরকার।’
সোহাগ গাজীর প্রতি দারুণ সমবেদনা গাজী আশরাফের। তিনি বলেন, ‘সোহাগ কঠিন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছে। বোলিং অ্যাকশন শুধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরাটা খুব কঠিন। এখানে কেবল ফিরলেই তো হবে না, পারফরমও করতে হবে। তাই সোহাগের সামনে কঠিনতম দিন অপেক্ষা করছে। তবে আমার বিশ্বাস সোহাগ কঠিনকে সহজ করেই দেখাবে।’
গাজী আশরাফ অনুযোগ করে বলেন, এই সোহাগকে নিয়েই কিছু দিন আগে কাজ করেছেন বিসিবির স্পিন পরামর্শক সাকলাইন মুশতাক। তাঁর মতো বিশ্বখ্যাত বোলারের চোখে সোহাগের অ্যাকশন-ত্রুটি ধরা পড়ল না! গাজী আশরাফ মনে করেন, এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া এ ধরনের কোচ বা পরামর্শকের কর্মপরিধির মধ্যেই থাকা উচিত।