দু’দল পরিবহন শ্রমিক ও পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষে সিলেটের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও আশপাশ এলাকায় নির্বিচারে গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সময় ৩টি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ শর্টগানের গুলি ও টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে অন্তত ২০ জন আহত হন। এ ঘটনা পর বিকেল ৩টা থেকে ঢাকাসহ সিলেটের সব ক’টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে সিলেট জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। আজ থেকে সিলেট জেলায় অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। এ সময় নির্বিচারে বাস, মিনিবাস, ট্রাক ও মাইক্রোবাস ভাঙচুরের প্রতিবাদে তারা বিক্ষোভ করে। এদিকে, বিকালে সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় চলাচলের সময় বেশ কয়েকটি বাস ভাঙচুর করা হলে গোটা জেলায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রী ওঠানামাসহ চলাচল নিয়ে সিলেটের বাস-মিনিবাস শ্রমিকদের সঙ্গে সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিকদের মধ্যে বেশ কয়েক মাস ধরে বিরোধ চলছে। এ বিরোধের পর থেকে উভয় সংগঠনের নেতারা পৃথকভাবে অবস্থান নিয়েছেন। সিলেটে সিএনজি ছিনতাই, চালক হত্যার বিচার, গাড়িতে গ্রিন না লাগানোসহ ৭ দফা দাবিতে গতকাল শনিবার সিলেটে ধর্মঘট আহ্বান করে সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন। একই সঙ্গে তারা সিলেটে মহাসমাবেশও আহ্বান করে। এ কারণে সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে সিএনজি অটোরিকশা চালকরা অবস্থান নেন। দুপুরের পর থেকে তারা দলবেঁধে মিছিল সহকারে সমাবেশস্থল সিলেটের রেজিস্ট্রারি মাঠের দিকে আসছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা পৌনে ২টার দিকে শ’ শ’ সিএনজি শ্রমিক মিছিল নিয়ে দক্ষিণ সুরমায় আসে। এ সময় তাদের গ্রুপগুলো দক্ষিণ সুরমার আলমপুর, কদমতলী, হুমায়ূন রশীদ চত্বর, চণ্ডিপুলসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় অবস্থান নেয়। অবস্থানের এক পর্যায়ে সিএনজি শ্রমিকরা আলমপুর থেকে কিন ব্রিজের দক্ষিণপ্রান্ত পর্যন্ত তাণ্ডব শুরু করে। অপর অংশটি চণ্ডিপুল এলাকায় তাণ্ডব চালায়। তাণ্ডবের এক পর্যায়ে তারা অর্ধশতাধিক বাস, মিনিবাস, ট্রাক, মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন প্রকাশ যানবাহন ভাঙচুর করে। এতে করে কদমতলীস্থ টার্মিনাল এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় আধা ঘন্টায় আকস্মিক তাণ্ডবে হতভম্ব হওয়া বাস ও মিনিবাস শ্রমিকরা তাদের তাণ্ডব প্রতিরোধের চেষ্টা চালালে শুরু হয় সংঘর্ষ। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও গাড়ি ভাঙচুর চলে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে দেন। প্রথমে স্বপ্নসংখ্যক পুলিশ সেখানে থাকলেও পরে রিজার্ভ পুলিশ নেয়া হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করার পর ২৯ রাউন্ড শটগানের গুলি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এ সময় শ্রমিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ ঘটনার পর সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিকরা সমাবেশ স্থলে চলে আসেন। আর ক্ষুব্ধ বাস শ্রমিকরা অবস্থান নেন টার্মিনাল এলাকায়। তারা টার্মিনালে বিক্ষোভ করতে থাকেন। একপর্যায়ে রাস্তায় চলাচলকারী ১০টি অটোরিকশা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। নতুন ব্রিজের রাস্তার ওপর তিনটি সিএনজি অটোরিকশায় আগুন দেখতে পান স্থানীয়রা। এক পর্যায়ে কদমতলী এলাকায় পুলিশের টহলে থাকা একটি সিএনজি অটোরিকশাকে ভাঙচুর করে। প্রায় আধা ঘণ্টা তাণ্ডব চালানোর পর পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দিলে সিলেট পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা কদমতলী এলাকায় অবস্থান নেন। সংঘর্ষকালে ইটপাটকেল হামলায় উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন শ্রমিক আহত হয়েছে। বাছা মিয়া নামের এক পরিবহন শ্রমিককে ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরও কয়েকজনকে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সমাবেশ স্থলে আসা সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিকরা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তাদের মিছিলে উসকানি দেয়ার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। তারা দাবি করেন, পুলিশ তাদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে। এতে তাদের কয়েকজন শ্রমিক আহত হন। এছাড়াও তাদের কয়েকজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। এদিকে, হামলা ভাঙচুরের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়া চালকরা সিলেট থেকে সব রুটে দূরপাল্লা ও স্বল্পপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দেন। সন্ধ্যো ৬টা পর্যন্ত বাস চলাচল শুরু হয়নি। সিলেটের গ্রীনলাইন, শ্যামলী, ইউনিক, হানিফ সহ বেশ কয়েকটি বাস সার্ভিসের কাউন্টারে যোগাযোগ করে জানা যায়, তাদের কয়েকটি গাড়ি ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেতে কাউন্টারের সামনে ছিল। ওই বাসগুলো ভাঙচুর করায় তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আর নতুন বাস না আসায় তারা ঢাকায় যেতে পারছেন না। হঠাৎ করে সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ায় ঢাকা, চট্টগামসহ সকল স্থানের যাত্রীরা সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েন। সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক মনির মিয়া জানান, মালিক ও শ্রমিকরা গাড়ি রাস্তায় বের করতে ভয় পাচ্ছেন। এজন্য কোন রুটেই গাড়ি চলছে না। তিনি জানান, অটোরিকশা শ্রমিকদের তাণ্ডবে যাত্রীরাও আহত হয়েছেন। সংঘর্ষের পর পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে পরিবহন শ্রমিক নেতারা সন্ধ্যায় বৈঠক করেন। সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সেলিম আহমদ ফলিক জানিয়েছেন, তাদের শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। সিএনজি শ্রমিকরা শ’ শ’ কোটি টাকার ক্ষতি সাধন করেছে। নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় কেউ গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছেন না। তিনি বলেন, এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হলেও চালকরা গাড়ি নিয়ে বের হবে না। সিলেটের টার্মিনাল ফাঁড়ির ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, সংঘর্ষের সময় পুলিশ ২৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ছুড়েছে। এ সময় টিয়ারশেল ছোড়া হয়। ঘটনায় পুলিশ ৯ জনকে আটক করেছে। এদিকে, সন্ধ্যায় পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা জানিয়েছেন, এ ঘটনার পর সিলেটের গোলাপগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সিএনজি চালকরা চলাচলকারী বাসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা করে। এতে গোটা জেলায়ই আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে দাবি করেন তিনি। এদিকে সন্ধ্যায় পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ থেকে সিলেট জেলায় অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে।