চলতি আগস্টের ৬ তারিখে প্রজ্ঞাপন জারি করার আগে থেকেই জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারির পরও সেই আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ আগস্ট ১৪ ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে আর্টিক্যাল ১৯সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন মিলে একটি গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে যেখান থেকে একটি অভিন্ন গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের দাবি ওঠে। আমি দাবিটি উত্থাপন করার পর বিএফইউজে নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল এবং ড. গোলাম রহমান এই দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। তবে নীতিমালাটি নিয়ে বিতর্কের অবসান এখনও হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি ২০ দলীয় রাজনৈতিক জোট সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করেছে। নীতিমালার কপি পোড়ানো থেকে শুরু করে এর বাক্য-শব্দ চুলচেরা ময়না তদন্ত অব্যাহতই আছে। বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলোর গরম অবস্থা চরম পর্যায়েই আছে। আমার জানা মতে, মিডিয়াতো বটেই অন্য কোন নীতিমালা নিয়ে এমন ব্যাপক আলোচনা কমই হয়েছে। তবে আমার কাছে পুরো বিষয়টিই কেমন যেন তালগোল পাকানো মনে হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে আজকের দিনে সম্প্রচার নীতিমালা বা অনলাইন নীতিমালা কিংবা সংবাদপত্র নীতিমালা নামে আলাদা আলাদা কয়েকটি নীতিমালা প্রণয়ন করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। আজকের দিনে কাগজ, টিভি বা অনলাইন পোর্টাল বলতে আলাদা আলাদা কিছু নেই। এখন পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ থাকে। সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানের থাকে ওয়েবসাইট। অনলাইনতো সংবাদপত্র আর সম্প্রচারের সম্মিলিত রূপ। অন্যদিকে আইপি টিভি-আইপি রেডিও জাতীয় প্রযুক্তির ফলে মোবাইল ফোন থেকে সিনেমা হল পর্যন্ত ডিজিটাল প্রযুক্তির যে দাপট তাতে কোনটাকে কোনটা থেকে আলাদা করা যাবে তা বলা কঠিন। এখন ইচ্ছে করলে যে কেউ সরকারের সম্প্রচারের লাইসেন্স ছাড়া ইন্টারনেট প্রটোকলকে ব্যবহার করে রেডিও বা টিভি সম্প্রচার করতে পারেন। বস্তুত এটি বৈধ না অবৈধ সেটিও কোন আইনে স্পষ্ট করে বলা নেই। কোন নীতিমালায় এর উল্লেখও নেই। ফলে কোন একটি অনলাইন গণমাধ্যম একই সাথে একটি কাগজের পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশনের সম্মিলিত প্রকাশনা ও প্রচারের কাজ করে যেতে পারে। ভাবতে হবে যে, সেই গণমাধ্যমটির জন্য কোন নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। অন্যদিকে মিডিয়াতো কেবল কাগজ, টেলিভিশন, বেতার বা পোর্টালের মাঝে সীমিত নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বড় ধরনের মিডিয়ায় পরিণত হয়েছে। ব্লগ নামক ইন্টারনেটভিত্তিক একটি কর্মকাণ্ড অন্য সকল মাধ্যমের চাইতে শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। আমরা যদি গণজাগরণ মঞ্চের উদ্ভব ও বিকাশের দিকে তাকাই তবে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্লগের ক্ষমতার বিষয়টি আঁচ করতে পারব। ফলে একদিকে মিডিয়া বা গণমাধ্যমের সংজ্ঞা যেমন বদলাতে হবে তেমনি সনাতনী মানসিকতাকেও পাল্টাতে হবে। ডিজিটাল যুগের উপযুক্ত মানসিকতা ছাড়া এই যুগের কিছুই সামনে নেয়া যাবে না। সেই কারণেই বহুদিন ধরেই আমি একটি জাতীয় গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলে আসছি। যদিও সম্প্রচার ও অনলাইন এ্ই দু’টি নীতিমালা প্রণয়ন করার কমিটিতেই আমি যুক্ত তবুও আমি সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন গণমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়নের পক্ষে। একই সাথে আমি এটি মনে করি যে প্রচলিত পত্রিকার ডিক্লারেশন পদ্ধতি, প্রেসের ডিক্লারেশন, টিভি-বেতারের লাইসেন্স, অনলাইন পোর্টালের লাইসেন্স, আইপিটিভি-আইপিরেডিও, ব্লগ বা অন্যসব ডিজিটাল মাধ্যমের অনুমতি দেবার জন্য একটি নীতিমালা ও একটি কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত। এখন ডিসি সাহেবরা কেন পত্রিকার ডিক্লারেশন দেবেন সেটি আমি বুঝি না। অন্যদিকে লেসার প্রিন্টার ও প্লটার দিয়ে যখন আমি যা খুশি ছাপতে পারি তখন ছাপাখানার কেন ডিক্লারেশন লাগবে সেটাও জানি না। আবার কাগজের পত্রিকার সাংবাদিকদের জন্য ওয়েজ বোর্ড থাকবে টিভি-অনলাইনের জন্য থাকবে না সেটি কেন তাও বুঝি না। প্রেস কাউন্সিল কি ভূমিকা পালন করে সেটিও আমি বুঝতে অক্ষম।
আমি মনে করি সরকার হযবরল যুগের অবসান ঘটিয়ে ডিজিটাল যুগের জন্য একটি গণমাধ্যম কমিশন গড়ে তুলবে ও তারই আলোকে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর সমন্বয় করবে।
লেখক:তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা
ই-মেইল ঃ mustafajabbar@gmail.com