দিনের পর দির ধরে চলা অনিয়ম যেনো শিকড় গেঁড়ে বসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনিয়মিই এখানে নিয়মে পরিনত হয়ে গেছে। আর এদিকে এসব অনিয়ম, দূর্নীতি আর অব্যাবস্থাপনার কারনে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। এমনকি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাস করা স্নাতকদের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
দৈনিক সমকালের এক অনুসন্ধানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম উঠে এসেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অতীতে নিম্নপদে থেকে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হওয়া একাধিক কর্মকর্তাকে চাকরিতে ফিরিয়ে এনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। কলেজ পরিদর্শন শাখাকে কেউ বলেন ‘জাপান’, আবার কেউ বলেন ‘কুয়েত’ শাখা। টাকাকড়ি ছাড়া এ শাখায় কোনো কাজ হয় না। সারাদেশের কলেজগুলোর অধিভুক্তি, তদন্ত, পরিদর্শন ও গভর্নিংবডি অনুমোদনে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাতে-নগদে ছাড়াও ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, বড় বড় মাছসহ নানা ধরনের উপঢৌকন প্রকাশ্যেই নিয়ে থাকেন।
জানা গেছে, গত কয়েক বছরেই এ শাখার সুপারিশে সিন্ডিকেট প্রায় সাড়ে ৭০০ কলেজ অধিভুক্তি দিয়েছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যত্রতত্র প্রতিষ্ঠা করা এসব কলেজে অনার্স ও ডিগ্রি (পাসকোর্স) খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। উপাচার্য হারুন অর রশীদ বলেন, ‘কলেজ পরিদর্শকের দপ্তরে একদিনও ফাইল আটকে থাকে না। তবে দপ্তরের কর্মকর্র্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার রাতারাতি ভালো বানানো দুরূহ। অনেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে নিজেদের লাটসাহেব মনে করেন।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ পদের বেশির ভাগই পাঁচ বছর ধরে চলছে ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১০ সালে ‘রেজিস্ট্রার’ এবং ‘পরিচালক (অর্থ ও হিসাব)’ এ দুই পদে ভারপ্রাপ্ত করা হয় উপপরিচালক মোল্লা মাহফুজ আল হোসাইনকে। ওই সময় তার চাচা সৈয়দ আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত কলেজ পরিদর্শকের দায়িত্ব পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর শামছুদ্দিন ইলিয়াস। তিনি ভিসির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বলে পরিচিত। ভারপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ান করা হয়েছে সহযোগী অধ্যাপক মো. নাসির উদ্দিনকে।
অর্ধশতাধিক সিনিয়র শিক্ষক কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে প্রক্টর নিয়োগ করা হয়েছে সহকারী রেজিস্ট্রার (বর্তমানে ডেপুটি রেজিস্ট্রার) তায়েহীদ জামিল শিপুকে। ২০০৭ সালের অনার্স পার্ট-২ ইংরেজি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছিল সে সময় গঠিত তদন্ত কমিটি। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে উপ-রেজিস্ট্রার আবু হানিফকে। আবু হানিফ সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থাকাকালে ২০০৪ সালে নম্বরপত্র জালিয়াতি করার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন। শারীরিক শিক্ষা দপ্তরে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক করা হয়েছে উপ-রেজিস্ট্রার এম রুহুল আমিনকে। তিনি উপ-কলেজ পরিদর্শক থাকাকালে রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ওই ঘটনায় তিনি দীর্ঘদিন সাময়িক বরখাস্ত ছিলেন। পরে পাঁচ বছরের জন্য পদোন্নতি ও ইনক্রিমেন্ট স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তে তাকে পুনরায় বহাল করা হয়।
পরীক্ষার খাতা জালিয়াতি: পরীক্ষা শাখায় চলছে খাতা জালিয়াতির মচ্ছব। সিসিটিভির ক্যামেরা বন্ধ করে রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে পরীক্ষার খাতা নিয়ে গিয়ে লিখে আনার ঘটনা সম্প্রতি ধরা পড়েছে। মকবুল নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ এক কর্মচারীই এ সিন্ডিকেটের হোতা। তিনি এ পর্যন্ত এ ঘটনায় ধরা পড়ে গ্রেফতার হয়েছেন অন্তত পাঁচবার। যতবার আটক হন, ততবারই বেরিয়ে আসেন গাজীপুরের রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরীক্ষা এলেই সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা মকবুল নেটওয়ার্কের সদস্যরা সক্রিয় হয়।
উপাচার্য হারুন অর রশীদ বলেন, খাতা নিয়ে নয়ছয় করার দিন শেষ। আমরা একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করছি। কোন পরীক্ষক কোন বিষয়ের কয়টি খাতা দেখছেন, তার হিসাব এক ক্লিক করলেই পাওয়া যাবে।’ তিনি বলেন, সবকিছু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে একটু সময় প্রয়োজন।
দুঃসহ সেশনজট: দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সেশনজট এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শাহীন আলম ও আসমাউল হুসনা রিক্তা কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। বর্তমানে তারা তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। তারা জানান, চলতি বছরের প্রথম দিকে দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করলেও এখনও ফল প্রকাশ হয়নি। তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষাও এগিয়ে আসছে। এ অবস্থায় কবে ফল প্রকাশ হবে, তা তাদের জানা নেই। শাহীন বলেন, তার বন্ধুরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তারা যখন মাস্টার্স শেষ করবে, তখন আমাদের অনার্স শেষ হবে।
এসব ব্যাপারে প্রোভিসি প্রফেসর ড. মো. আসলাম ভূঁইয়া জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার সঠিক গতিতে এগিয়ে চলছে। কর্মকর্তা শূন্যতার কারণে অনেক পদ ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে চালানো হচ্ছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত সব পদে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, অতীতের চেয়ে দ্রুত সময় ভর্তি, ক্লাস, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশ করায় সেশনজট কমে এসেছে।