ঢাকার একটি ক্লাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের ক্রিকেট কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার। ঢাকায় পৌঁছার পর বিমানবন্দর থেকেই তাঁকে হেলিকপ্টারে করে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেলে ঢাকায় আরেকটি অনুষ্ঠানেও যোগ দেন তিনি। ওই দিন রাতেই তিনি ঢাকা ছাড়েন।
শচীন ১০ ঘণ্টারও কিছু বেশি সময় বাংলাদেশে ছিলেন। এত অল্প সময়ে বিভিন্ন স্থানে একাধিক অনুষ্ঠানে যে তিনি উপস্থিত থাকতে পেরেছেন, তা সম্ভব হয়েছে শুধুই হেলিকপ্টারে যাতায়াতের কারণে।
হয়তো নিরাপত্তার কথা ভেবেই ক্লাব কর্তৃপক্ষ শচীন টেন্ডুলকারকে হেলিকপ্টারে যাতায়াত করিয়েছেন। দেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানও নিজ বাড়ি মাগুরায় যেতে অনেক সময় হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন। এতে একদিকে তাঁরা যেমন যানজটের ভোগান্তি এড়াতে পেরেছেন, অন্যদিকে মূল্যবান সময়ও বাঁচিয়েছেন।
তবে যানজটের এই ভোগান্তি বেশি পোহাতে হয় এ দেশে ব্যবসার কাজে আসা বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীদের। সে কারণেই এ দেশে আসা ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন ঢাকার বাইরে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন হেলিকপ্টারকে। ঢাকা থেকে দূরবর্তী চট্টগ্রাম, সিলেটের মতো শহরের পাশাপাশি ঢাকার কাছাকাছি নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর কিংবা ময়মনসিংহে কারখানা পরিদর্শন করতে বিদেশি ব্যবসায়ীরা এখন হরহামেশাই হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন।
আর রপ্তানিকারক তথা এ দেশের ব্যবসায়ীরাও বিদেশি ক্রেতাদের সন্তুষ্টির জন্য অনেক সময়ই শরণাপন্ন হচ্ছেন বেসরকারি হেলিকপ্টার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর। জরুরি প্রয়োজনে তাঁরা নিজেরাও হেলিকপ্টারে যাতায়াত করছেন। এসব কারণে দেশে হেলিকপ্টারে যাতায়াতের চাহিদা বাড়ছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) দেওয়া তথ্য অুনযায়ী, তিন বছর আগেও দেশে বেসরকারি পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে হেলিকপ্টার ভাড়া দেওয়ার কাজ করত মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান। তবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গত তিন বছরে নতুন করে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারিভাবে হেলিকপ্টার ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা শুরু করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো স্কয়ার এয়ার লিমিটেড, সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইনস, মেঘনা এভিয়েশন, আরঅ্যান্ডআর এভিয়েশন, ইমপ্রেস এভিয়েশন, বাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস এবং বিআরবি এয়ার লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় বর্তমানে হেলিকপ্টার আছে ১৫টি। চার বছর আগে তাদের সম্বল ছিল মাত্র পাঁচটি হেলিকপ্টার।
হেলিকপ্টার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের যেকোনো স্থানে হেলিকপ্টারে ভ্রমণের জন্য প্রতি ঘণ্টায় (ফ্লাইং আওয়ার) ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা খরচ পড়ে। কোথাও যাত্রাবিরতি (গ্রাউন্ড ওয়েটিং) করলে প্রতি ঘণ্টায় মাশুল দিতে হয় পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। এসব মাশুলের সঙ্গে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করও (মূসক) আরোপ করা হয়।
১৯৯৯ সালে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে হেলিকপ্টার সেবা চালু করে সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইনস। এ খাতে সর্বশেষ সংযোজন ২০১৪ সালের মার্চ মাসে যাত্রা শুরু করা ইমপ্রেস এভিয়েশন।
ইমপ্রেস এভিয়েশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখনো হেলিকপ্টার ব্যবসায়িকভাবে ভাড়া দেওয়ার চেয়ে নিজেদের প্রয়োজনেই বেশি ব্যবহার করছি। তবে দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সেবাভিত্তিক শিল্প হিসেবে হেলিকপ্টার সেবা গড়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।’ গণমাধ্যমের জরুরি সংবাদ সংগ্রহ, নাটক কিংবা সিনেমার শুটিং, রাজনৈতিক নেতাদের সফরের কাজেও এখন হেলিকপ্টারের ব্যবহার বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
হেলিকপ্টার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তাদের যাত্রীর একটি বড় অংশই এ দেশে আসা তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতারা।
বিষয়টি স্বীকার করে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যানজটের কারণে সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বা একটু দূরের কোনো শহরে যেতে এখন অনেক ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতেই অনেক সময় ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লাগে। আবার অনেক জায়গায় রাস্তার অবস্থাও খুব খারাপ। এত সময় ব্যয় করে খারাপ রাস্তা দিয়ে একজন বিদেশি কেন ওই সব জায়গায় যাবেন? সময় বাঁচাতে তাই অনেক সময় বাধ্য হয়েই আমাদের হেলিকপ্টার ভাড়া করতে হয়।’
একটি হেলিকপ্টার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দেশের অভ্যন্তরে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর ব্যবসা ও কলকারখানার সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এসব শিল্পগোষ্ঠীর মালিকেরা তাঁদের মালিকানাধীন শিল্পগুলো দেখভাল করার জন্য ও জরুরি ব্যবসায়িক প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন।
স্কয়ার এয়ারের পরিচালক (অপারেশনস) ও প্রধান পাইলট সৈয়দ সাখাওয়াত কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্কয়ার হাসপাতালের মুমূর্ষু রোগীদের আনার জন্যই আমরা ২০১০ সালে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে হেলিকপ্টার সার্ভিসটির শুরু করি। তবে এই সেবা ছাড়াও দেশের যেকোনো স্থানে যাত্রী পরিবহন করি আমরা। এর পাশাপাশি স্কয়ার গ্রুপের বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়।’ বর্তমানে স্কয়ারের মালিকানায় দুটি হেলিকপ্টার আছে বলে তিনি জানান।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, জ্বালানি তেল, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, পাইলটসহ কারিগরি কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বেতনসহ মাসে একটি হেলিকপ্টারের পেছনে অন্তত ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। পাশাপাশি হেলিকপ্টার রাখার জন্যও (হ্যাঙ্গার) অনেক বড় জায়গার প্রয়োজন হয়। প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই মূলত হেলিকপ্টারের পাইলট হিসেবে কাজ করেন। উচ্চ প্রশিক্ষিত হওয়ায় তাঁদের পারিশ্রমিকও বেশি।
পরিচালনার এই উচ্চ ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে গত ১২ বছরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হেলিকপ্টার ব্যবসাও গুটিয়ে নিয়েছে। ২০০০ সালে অ্যারো টেকনোলজিস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে হেলিকপ্টার সেবা চালু করেছিল। গ্রাহক আকৃষ্ট করতে না পেরে ২০০৮ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি সেবাটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।
এ ছাড়া বেস্ট এয়ার ২০০২ সালে হেলিকপ্টার সেবা চালু করে কয়েক মাস পরেই বন্ধ করে দেয়। নিটোল গ্রুপের নিটোল এভিয়েশন সার্ভিস লিমিটেড বেশ আয়োজন করে ব্যবসা চালু করলেও এখন নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
অন্য চিত্রও আছে। ২০০৬ সালে চালু হওয়া বাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস গ্রাহক না থাকায় মাঝে কয়েক বছর নিষ্ক্রিয় ছিল। তবে এখন পুনরায় চালু হয়েছে, যাত্রীসেবাও দিচ্ছে।
হেলিকপ্টার ভাড়া নেওয়ার চাহিদা বাড়লেও সামগ্রিকভাবে এই ব্যবসা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না মালিক ও পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো। তারা বলছেন, এখনো পরিচালন ব্যয় মিটিয়ে মুনাফা করতে পারছেন না তাঁরা। সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দু–একটি বাদে বেশির ভাগই মাসে ব্রেক ইভেনে (না লাভ না লোকসান অবস্থা) যেতে পারছে না। বড় অঙ্কের বিনিয়োগের কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক হতে আরও সময় লাগবে বলে তাঁরা মনে করেন।
ব্যবহার
স্থানীয় রপ্তানিকারক–ব্যবসায়ীরা নিজেদের জরুরি প্রয়োজনে ও বিদেশি ক্রেতাদের সন্তুষ্টির জন্যও অনেক সময় হেলিকপ্টার ভাড়া করেন
গণমাধ্যমের জরুরি সংবাদ সংগ্রহ, নাটক কিংবা সিনেমার শুটিং, রাজনৈতিক নেতাদের সফরের কাজেও হেলিকপ্টার ভাড়া হয়
হেলিকপ্টারের মালিকেরা নিজেদের ব্যবসায়িক প্রয়োজনেও এটি ব্যবহার করে থাকেন
যাত্রা শুরু
১৯৯৯ সালে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে হেলিকপ্টার সেবা চালু করে সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইনস
সর্বশেষ সংযোজন
এ খাতে সর্বশেষ সংযোজন ২০১৪ সালের মার্চ মাসে যাত্রা শুরু করা ইমপ্রেস এভিয়েশন
ভাড়া
ঘণ্টাপ্রতি ভাড়া ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ১৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে ১৫% ভ্যাট যোগ হয়