মোঃ খলিলুর রহমান (লেখক-সাংবাদিক)
১০ নভেম্বর সকলের কাছে পরিচিত শহীদ নূর হোসেন দিবস। সে দিন খালি গায়ে স্বৈরাচার নিপাত যাক, আর পিঠে গণতন্ত্র মুক্তি পাক- ¯ে¬াগান লিখে রাজপথের মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিল নূর হোসেন। সে ইতিহাস আমাদের সকলের জানা। যে ইতিহাস আমাদের কাছে অজানা তা হল সেদিন নূর হোসেনের মতো স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জয়গান গাইতে গাইতে আর একজন যুবকের হাসিমুখে আÍহুতি দিয়েছিলেন।তিনি হলেন সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটো।
সম্মিলিত বিরোধী জোটের ওই দিনের কর্মসূচি প্রতিহত ও বানচাল করতে এরশাদ সরকার ট্রেন, বাস সহ সারা দেশের যোগাযোগ অচল করে দিয়েছিল। সে কারণে অবরোধের আগের দিন টিটো বাইসাইকেলে করে ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ৯ নভেম্বর কয়েক জন সহপাঠী নিয়ে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার পথ বাইসাইকেলে পাড়ি দিয়ে বাজিতপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছান।
টিটোর পরিবার, সংগঠন ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১০ নভেম্বর তোপখানা রোডে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেনের সঙ্গে টিটোও শহীদ হন। ১১ নভেম্বরের খবরের কাগজে নূর হোসেন ছাড়াও অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের লাশের ছবি ছাপা হয়। কিন্তু ওই দিন টিটোর লাশ শনাক্ত করা যায়নি। পুলিশ তাঁর লাশ গুম করে ফেলে।
সৈয়দ আমিনুল হুদা টিটো কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার দুলালপুর ইউনিয়নের দুলালপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৬২ সালের ১২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ ।স্কুল জীবন থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যা নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন। গতানুগতিক শিক্ষা টিটোর একেবারে অপছন্দ ছিল। শিক্ষাকে গণমুখী করার জন্য সকলের জন্য শিক্ষার দাবিতে স্কুল জীবন থেকে টিটোর সংগ্রামী জীবন শুরু হয়। এসএসসি পাস করে টিটো যখন কলেজে ভর্তি হন, তখন থেকে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের বাজিতপুর কলেজ শাখার সভাপতি এবং কিশোরগঞ্জ জেলা কমিটির সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।টিটো ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হয়েও, তাঁর গ্রামে ক্ষেতমজুর সমিতি গড়ে তোলার জন্য বাজিতপুরের ক্ষেতমজুর নেতা অ্যাডভোকেট শৈলেশ্বর দাস, ইন্দ্রজিত স্যারকে দাওয়াত দিয়ে তাঁর গ্রামে নিয়ে যেত এবং ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত করে অল্পদিনের মধ্যে তিনি তাঁর এলাকায় বিশাল ক্ষেতমজুর সমিতি গড়ে তোলন। খাস জমির আন্দোলনে ভাসমান পানিতে মাছ ধরার আন্দোলনে টিটো ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে গরিব মানুষের নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। শুধু তাই নয়, ১৯৮৬ সালের শিক্ষক আন্দোলনে বাজিতপুরে শিক্ষকদের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন। স্বৈরাচারী এরশাদের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ও শিক্ষকদের দাবি পূরণের জন্য শিক্ষকরা যখন আন্দোলনে যুক্ত হন, তখন টিটো সেই আন্দালনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মিছিলে তাঁর ¯ে¬াগান সবাইকে ও বক্তৃতায় প্রতিটি শিক্ষকের হৃদয় জয় করতে পেরেছিলেন। এভাবে শিক্ষকদের মধ্যে কাজ করে বাজিতপুরের সকল শিক্ষকের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেন। টিটো বিএ পড়া অবস্থায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির বাজিতপুর শাখার সহ-সাধারণ স¤পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সক্রিয় কর্মী হিসাবে কাজ করেন। উদীচীসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর ছিল সরব পদচারণা। কবিতা ও গল্প লেখায়ও পাকা হাত ছিল।
তিনি চাইতেন মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে, তিনি চাইতেন হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিরি ধারা প্রবর্তন করতে। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিরামভাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ভেতরে কাজ করতেন। টিটোর যোগাযোগ ছিল অবহেলিত, গরিব-দুঃখী ও উপবাসী মানুষের সাথে। ব্যাক্তিগতভাবে বহু অসহায় মানুষকে খাবার দিয়ে, ওষুধ দিয়ে এবং শীতের বস্ত্র দিয়ে সাময়িকভাবে সমস্যা সমাধান করতে টিটো উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। টিটোর কণ্ঠস্বর ছিল মধুর। তিনি উদীচীর গান গাইতে পারতেন, তিনি ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালী গাইতে পারতেন। আঞ্চলিক গান, নানা রূপকথার গল্পও জানতেন। তিনি গাইতে পারতেন নজরুল সঙ্গীত ও রবীন্দ্র সঙ্গীত। তিনি শিকল ভাঙার গান গাইতেন। সাম্যের গান গাইতেন।
টিটো গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন যুবক ছিলেন। তিনি সংগঠনের সকলের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। স্বেচ্ছাচারী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন না। এজন্য স্বৈরাচার ছিল তাঁর অতি অপছন্দনীয়, তাঁর পতনের জন্য দিনরাত কাজ করতেন। স্বৈরাজারের পতনের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে সন্ত্রাস কমবে, লুটপাট বন্ধ হবে, অন্ততপক্ষে ব্যাপক হারে শোষণ বন্ধ হবে। গণ মানুষের দাবি উপেক্ষিত হবে না। কৃষক-ক্ষেতমজুর দাবি বাস্তবায়ন হবে। এরশাদের পতন ঘটানোই ছিল তাঁর রাজনৈতিক ক্রিয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত এরশাদের পতন না হবে, ততক্ষণ তিনি ক্লান্ত হবেন না, সেই লক্ষ্যে টিটো অবিচল ছিলেন।
সত্যিকারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় টিটোর মতো মানুষের প্রয়োজন আজ সবচেয়ে বেশি।টিটোর মতো আদর্শবান মানুষের প্রয়োজন জাতি আজ মর্মে উপলব্ধি করে। টিটোর মতো মানুষের সংখ্যা বাড়াতে পারলেই সমাজ থেকে অনিয়ম, অবিচার, সন্ত্রাস, কালো টাকার দৌরাÍ হ্রাস পাবে এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। গণতন্ত্রকে কালো টাকার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে দেশপ্রেমিক, ত্যাগী, নিষ্ঠাবান, পার্টির সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থাশীল টিটোর মতো সাহসী যুবকের আজ প্রয়োজন। যে যুবক মানুষের কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করবে।
মোহাম্মদ খলিলুর রহমান (লেখক-সাংবাদিক,সাবেক ছাত্রনেতা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন)