দেশের অন্যতম সচল ফল্ট জোনে অবস্থানের কারণে সম্ভাব্য বড় ধরণের ভূমিকম্পের আশঙ্কায় রয়েছে ময়মনসিংহ অঞ্চল। সরকারিভাবে সর্বশেষ সংশোধিত সিসমিক জোন মানচিত্রের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থান করছে এই অঞ্চল। বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হলে বদলে যেতে পারে বৃহত্তর ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভূ-মানচিত্র।
জানা যায়, ভূমিকম্প প্রবণ এলাকার মানচিত্রকে সিসমিক জোন মানচিত্র বলা হয়। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে সরকার জাতীয় বিল্ডিং কোড প্রণয়নের সময় প্রায় ২০০ বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে প্রাপ্ত সব ডাটা পুনর্মূল্যায়ন করে বাংলাদেশের জন্য একটি সংশোধিত সিসমিক জোন প্রণয়ন করে। সেই মানচিত্রে উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা ভূমিকম্পের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই জোনে রংপুর, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেটসহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশের কয়েকটি এলাকা রয়েছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, টাঙ্গাইল, বগুড়া ও দিনাজপুর সমন্বয়ে গঠিত ২ নম্বর জোনটিও ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের বাকি অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৩ নম্বর জোনে ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম। বাংলাদেশ আর্থকোয়াক সমিতির বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে যে আটটি সচল ফল্ট জোন রয়েছে তার অন্যতম ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ডাউকি ও ডুবরি এলাকা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, খুব কাছাকাছি সময়ে প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভূমিকম্প সংঘটিত হলে ব্রহ্মপুত্র নদ ফিরে পেতে পারে তার হারানো গতিপথ। তার পরিণতি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের আওতাভুক্ত বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৬ থেকে ৮ বা এর চেয়েও বেশি মাত্রার শক্তিশালী আরেকটি ভূমিকম্প হলে ময়মনসিংহের ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের বড় পরিবর্তনের আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিবর্তনের অন্যতম নিয়ামক হবে ব্রহ্মপুত্র নদ। ফলে এই নদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা বিস্তীর্ণ লোকালয়ের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে। ময়মনসিংহ জেলা সদরসহ জামালপুর, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার বড় একটি অংশ এই নদ তীরবর্তী অঞ্চলেই অবস্থিত।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময় বা প্রায় এক শতক আগে-পরে একই স্থানে বৃহৎ ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি হয়। ১৭০০ শতাব্দীর শেষ দশকে সংঘঠিত প্রবল ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে আজকের যমুনা নদীর উৎপত্তি। ১৮৯৭ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রবল ভূমিকম্প হয়েছিল। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮.৭০ আর উৎপত্তিস্থল ছিল শিলং প্লেট। সেই হিসাবে বাংলাদেশ যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।
এদিকে ময়মনসিংহে ভূমিকম্পের যত বড় আশঙ্কাই থাকুক না কেন, এর গুরুত্ব আর তা মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে ওয়াকিবহাল নয় কোনো কর্তৃপক্ষই। এ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। ফলে এখানে ঘরবাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে জাতীয় বিল্ডিং কোডকে থোরাই কেয়ার করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস ও পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন নেয়ার কথা থাকলেও ময়মনসিংহের দালান মালিকরা তা আমলে নিচ্ছেন না। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ময়মনসিংহ শহরে ৬ থেকে ১০ তলা বা তদুর্ধ্ব বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর নির্মিত ও নির্মিতব্য বেশ কয়েকটি হাইরাইজ ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, মার্কেট, শপিং মল বা সেন্টার ইত্যাদি নিয়মবহির্ভূতভাবে তৈরি হয়েছে বা তৈরির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এছাড়াও শহরাঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য পুরনো, মেয়াদ উত্তীর্ণ ও প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত বাড়িঘর।
তাছাড়া ময়মনসিংহ জেলায় সরকারিভাবে ভূমিকম্প সম্পর্কে সম্যক ধারণা বা তথ্য জানার জন্য সরকারি কোনো অফিসই নেই। এ বিষয়ে ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র ইকরামুল হক টিটু বলেন, আগের তুলনায় বর্তমানে বিল্ডিং কোড ও পৌরসভা প্রণীত প্ল্যান অনুযায়ী বাড়িঘর, স্থাপনা নির্মাণের তদারকির ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে ১৯৯৬ সালে প্রণীত নির্মাণ বিধিমালাকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। পুরনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঘড়বাড়ির ক্ষেত্রে শিগগিরই হোল্ডিং টু হোল্ডিং সার্ভে করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ভূমিকম্পের সচেতনতাবিষয়ক প্রচারণায় এডিপি ওয়ার্ল্ডভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়াকে ময়মনসিংহের বাস্তবতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে তিনি দাবি করেন।
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের আলোকে ইকরামুল হক টিটু বলেন এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন ও গণপূর্ত বিভাগের সমন্বয়ের মাধ্যমে পরবর্তী করনীয় নির্ধারণ করা হবে।