ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর দলীয় অন্তর্কোন্দলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের গ্রুপিং, গোলাগুলি, খুনোখুনি, আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন এবং যুবলীগের সঙ্গে ক্ষমতা নিয়ে লড়াইয়ের জেরে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে দলটি। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়েও বিরাজ করছে উত্তেজনা।
গতকাল ২০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতারা টাকার বিনিময়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি দিয়েছিলেন। ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা কমিটি বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চাইলে এ সংঘর্ষ বাধে।
গত ১৯ নভেম্বর বুধবার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে মারামারিতে লিপ্ত হয় ছাত্রলীগ। এখনও সেখানে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিদ্যমান।
বুধবার শিক্ষাভবনে টেন্ডার নিয়ে গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা। এ সময় ছাত্রলীগের এক কর্মী গুরুতর আহত হন।
আজ শুক্রবার কুমিল্লার তিতাস উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষে সেন্টু মিয়া নামে একজন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন অন্তত ২৪ জন।
বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের নান্দাইল পৌর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়েও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের নেতারা। সংঘর্ষে আবুল মনসুর নামে দলীয় এক কর্মী নিহত হন। বর্তমানে নান্দাইলে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের নেতাদের ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মহড়া দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ২৭ সেপ্টেম্বর চবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হয়। এতে তিনজন আহত হন। গত ৯ সেপ্টেম্বরও চবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের কোন্দল-সংঘাত নিরসনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিদের্শ দিলেও তাতে সুফল মেলেনি।
গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়- গত ২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত ফি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বদরুন্নেসা মহিলা কলেজে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের সংঘর্ষ হয়। ওই একই দিনে মানিকগঞ্জ ছাত্রলীগের দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়।
১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায় ছাত্রলীগ।
২২ ফেব্রুয়ারি খুলনার আজম খান কমার্স কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দলীয় কোন্দল থেকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
২ মার্চ বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হয়। এ ঘটনায় কমপক্ষে ২০ জন আহত হন।
এ ছাড়া টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজেও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পার বিরুদ্ধে জোর করে ছাত্র সংসদের ভিপি পদ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতাদের মতে, এ অবস্থার জন্য দায়ী কেন্দ্রের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হয় ২০১২ সালের ৮ মে। ওই সময় থেকে পদবঞ্চিতরা বিক্ষোভ করে আসছেন। বৃহস্পতিবারই প্রথম সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করেন। আর ছাত্রলীগ শাবি কমিটি কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে চেয়েছিল বলে জানা গেছে।
ছাত্রলীগ নেতারা জানান, গত চার বছরে বর্তমান কমিটি ১০১টি শাখা কমিটির মধ্যে নতুন করে মাত্র ২৭টি কমিটি করতে পেরেছেন। এর মধ্যে মাত্র সাতটি কমিটি হয়েছে সম্মেলনের মাধ্যমে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগ কমিটির মেয়াদ দুই বছর। বর্তমান কমিটি চলছে চার বছর। ফলে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।
ছাত্রলীগ সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান বলেন, ‘ছাত্রলীগের সম্মেলন নেত্রী যখন মনে করবেন তখনই হবে। দেশের কোথাও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। যে সব দোষ আমাদের প্রতি দেওয়া হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী। আমরা কখনও সংঘাত চাই না।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাজপথে বিরোধী দল বিএনপির কাছে আন্দোলনের কোনো ইস্যু ছিল না। কিন্তু ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কারণে বিএনপি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। আর মূল দলের বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি নিয়ে সৃষ্ট সংঘর্ষের কারণে আমরা বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়েছি। এ সব ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তবে সমস্যা নিরসনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘কিছু এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। যারা সংগঠনবিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘ছাত্রলীগকে রক্ষা করতে হবে। গুটিকয়েক দুষ্ট ছেলের জন্য ছাত্রলীগের ঐতিহ্য ম্লান হতে পারে না। এ ব্যাপারে সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে কঠোর হতে হবে।’
আওয়ামী লীগের কোন্দল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বড় দলে কিছুটা সমস্যা থাকতেই পারে।