দেশে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বীভৎসতা। ধর্ষণের চিত্র মুঠোফোনে ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বারবার ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন নারী। আবার ধর্ষণের শিকার নারী বা কিশোরীকে সেই ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে। এ কাজে সহায়তা করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হন ৫৪৪ জন। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ১৫০ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৭৮ জনকে। ৯৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ বছরে তিন হাজার ৯২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
এই অবস্থার মধ্যেই আজ মঙ্গলবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস।
ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে: সামাজিক বাস্তবতা, ধর্মীয় ব্যাখ্যাসহ বিভিন্ন অজুহাতে ধর্ষকের সঙ্গেই ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরের মে মাসে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি ঘটে জোরারগঞ্জ থানার ভেতরে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, জোরারগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক নাজমুল হাসান ধর্ষক ও তাঁর সঙ্গীদের আটক করেন। তাঁদের কাছ থেকে এক লাখ টাকা ঘুষও নেন। পরে তিন লাখ টাকা কাবিনে বিয়ে হয়।
টেলিফোনে উপপরিদর্শক নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েটি সেই ছেলেকে বিয়ে করার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। তারপর ছেলেটি বিয়ে করবে না বলে এবং ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। থানায় এসে মেয়েটি জানায়, সে ছেলেটিকে বিয়ে করতে চায়। মেয়ের বাবাও লিখিত আবেদন দিয়ে মামলা না করে বিয়ে দিয়ে দিতে বলেন। সামাজিকতার কথা চিন্তা করে বিয়ের আয়োজন করা হয়। আর লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার কথা সঠিক নয়। সে টাকা বিয়েতেই খরচ হয়েছে।’
গত সেপ্টেম্বরে নরসিংদীতে ধর্ষণের মামলার আসামির সঙ্গে বিয়ে হয় ধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে। সেই নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সত্য কথা বলতে আমি ভালো নেই। স্বীকৃতি পেতে এবং সেই মানুষটার মুখোশ সবার সামনে তুলে ধরতেই তাঁকে বিয়ে করি। আমি জানতাম, তাঁর আরও দুজন স্ত্রী আছে।’
গ্রাম্য সালিসে বিচার: ধর্ষণের বিচার হচ্ছে গ্রাম্য সালিসে। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার একজন গৃহবধূ চিকিৎসক রফিকুজ্জামানের কাছে যান চিকিৎসার জন্য। সেই চিকিৎসক কৌশলে গৃহবধূকে অচেতন করে ধর্ষণ করেন। ঘটনাটি পুলিশকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরে গ্রাম্য সালিসে ধর্ষণের শিকার গৃহবধূকে মারধর করে তাঁর স্বীকারোক্তি নেওয়া হয় যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। পরে সেই গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন।
মে মাসে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সুতি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ফজলুল হক ১২ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করা শাহজাহানকে গ্রাম্য সালিসে জুতাপেটার শাস্তি নির্ধারণ করেন।
বেড়েছে বীভৎসতা: প্রথম আলোতে গত দুই বছরে প্রকাশিত ধর্ষণসংক্রান্ত বিভিন্ন খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ধর্ষণের হাত থেকে চার বছরের শিশু, প্রতিবন্ধী এমনকি ৫৫ বছর বয়সী নারীও রেহাই পাননি। ধর্ষকেরা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, ধর্ষণের শিকার নারীকে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ বীভৎসভাবে প্রদর্শনও করেছে। বাসের মধ্যে ধর্ষণ করে চলন্ত বাস থেকে নারীকে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
মে মাসে প্রথম আলোর ভৈরব প্রতিনিধির পাঠানো খবর অনুযায়ী, সেখানে মৃত শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আবার একই মাসে রংপুরে গৃহবধূকে ধর্ষণ করার পর তাঁর শিশুপুত্রকে পাশের পুকুরে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন প্রথম আলোকে এ বিষয়ে বলেন, সামাজিক অবক্ষয় এবং মানুষের নৈতিক চরিত্রের স্খলনের ফলেই সমাজে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে।
দীর্ঘসূত্রতা, আপস: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সমন্বয়কারী চিকিৎসক বিলকিস বেগম সেন্টারে দায়িত্ব পালন করছেন ১০ বছর ধরে। তিনি বলেন, মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে বেশির ভাগ মামলা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে না। অনেকে আর সাক্ষ্য দিতে চান না। পরিবারটি দরিদ্র হলে কিছু টাকাপয়সা পাওয়ার জন্য মামলায় আপস করেন। আবার মেয়ের পরিচয় জানাজানি হলে বিয়ে দিতে পারবেন না—এ ভয়ে অনেকে এলাকাই ছেড়ে দেন।
বিলকিস বেগম তাঁর অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ২০০৬ বা ২০০৮ সালের মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য এখনো তাঁকে কোর্টে যেতে হয়।’
গাজীপুরে ১২ বছরের বাকপ্রতিবন্ধী এক শিশুর বাবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়ের ধর্ষণের বিচার চেয়ে করা মামলার পেছনে এ পর্যন্ত ২০-৩০ হাজার টাকা খরচ হইয়া গেছে। পুলিশ টাকা ছাড়া কথা বলে না। অক্টোবর মাসের ঘটনা। শেষ পর্যন্ত কত দিন মামলা চালাইতে পারমু, তা বুঝতে পারতেছি না।’
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় ২০১১ সালে বিধবা মরিয়ম মুরমুকে (৫৫) ধর্ষণ করার পর হত্যাও করে দুর্বৃত্তরা। ২০১২ সালে রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের বিশেষ আদালত তিন আসামিকে ফাঁসির আদেশ দেন। পরিবারের সদস্যরা সেই রায় বাস্তবায়নের জন্য প্রার্থনা করেন চলতি বছরের জুলাই মাসে।
কিছু ভালো পদক্ষেপ: রাজশাহীতে ১২ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের দায়ে সেরাজুল ইসলামকে (২৫) আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেন। ১২ বছরের শিশু ধর্ষণের ফলে এখন নিজেই সন্তানের মা। আদালত এই সন্তানের পিতৃপরিচয় হিসেবে সেরাজুল ইসলামের নাম ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে ২০১১ সালে। রায় হলো চলতি বছর।
আবার ধর্ষণ পরীক্ষাপদ্ধতির বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে করা রিটের কারণে হাইকোর্ট কমিটি গঠন করে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। এরপরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গঠিত কমিটি নীতিমালা তৈরি করেছে। গত বছর প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ধর্ষণের শিকার নারীর পরীক্ষা পুরুষ চিকিৎসককে দিয়ে করানোকে কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে আদালত রুল জারি করেন।
ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, হাইকোর্টের বিভিন্ন নির্দেশনার পাশাপাশি ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এ ছাড়া আসলেই ধর্ষণের শিকার কতজন সুবিচার পাচ্ছেন, আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সে ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করতে হবে।