মোঃ রুূবেল বেনাপোল: দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল কাস্টমসের অনিয়ম ও দূর্ণীতির কারণে আবারো রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও দূর্ণীতির কারণে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় কম হয়। এছাড়া, ২০১১-২০১২ ও ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরেও ঘুষ অনিয়ম ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতায় কাঙ্খিত রাজস্ব আদায় ব্যর্থ হয়। তবে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও দূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তারা তাদের ঘুষ বাণিজ্য আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে কয়েক আমদানীকারক ব্যবসায়িরা নাম না প্রকাশ শর্তে অভিযোগ করেছেন।
তাদের ভাষ্যমতে, ঘুষ ছাড়া বেনাপোল কাস্টমসের অধিকাংশ টেবিলের ফাইল নড়েনা। এ কারণে আমদানিকারকরা দেশের এ বৃহৎ স্থল বন্দর দিয়ে মালামাল আমদানিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থ বছরেও রাজস্ব আদায়ে ধস নামবে বলে আশঙ্কা করছেন ওই ব্যবসায়ীরা। অভিযোগের তীর বরাবরই কাস্টমস ও বন্দর কর্মকর্তাদের দিকে।
কাস্টমসের নির্ভরযোগ্য একটি সুত্রে জানিয়েছে, বেনাপোলের কিছু দূর্নীতিবাজ সিএন্ডএফ এজেন্টস ও কাস্টম কর্মকর্তাদের কারসাজিতে অতিমাত্রায় বেড়েছে শুল্ক ফাঁকি। এ কারণে বরাবরের ন্যায় রাজস্ব বোর্ডের বেধে দেওয়া রাজস্ব আদায়ে হোঁছট খাচ্ছে “সরকার” আর আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যাচ্ছেন এখানকার এক শ্রেণীর দূর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাসহ কিছু রাঘব বোয়াল সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীরা।
কাস্টমস সুত্রে আরো জানিয়েছেন, ২০১১ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পরপর ৩ টি অর্থবছর এ বন্দরে ধস লেগে আছে। ২০১১-১২ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৪’শ ২৫ কোটি টাকা। বছর শেষে ঘাটতি ছিল ১’শ ৯৪ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৬’শ ২০ কোটি টাকা। বছর শেষে ঘাটতি হয়েছে ৪’শ ৫২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৬’শ কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে আদায় হয়েছে ২ হাজার ৪’শ ৮০ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
এবার ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে এখানে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫’শ ৬৭ কোটি টাকা। কিন্তু এ অর্থ বছরেও ভাটা লেগে আছে বলে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমে জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বেনাপোল আর্ন্তজাতিক চেকপোস্টে রাস্তার উপর কয়েকটি টোং ঘর আছে। ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ন্যোম্যান্সল্যান্ড অতিক্রমের সাথে এখানে নাম লেখাতে কাস্টমসের টোং ঘরে ১০ টাকা ও পোর্টের টোং ঘরে ১০ টাকা করে ঘুষ শুরু হয়। পরে কার্গো শাখায় ম্যানিফিস্ট এন্ট্রি করতে ঘুষ ৩০ টাকা। এখান থেকে ট্রাক টার্মিনালে ঢোকে পোস্টিংয়ের জন্য বন্দরের শেড ইনচার্জকে দিতে হয় ৫০ টাকা। বন্দর অভ্যন্তরে সেডে পণ্য খালাস শেষে গেট পাশে সাইন করার জন্য এ শেড ইনচার্জকে আবার দিতে হয় ২’শ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা হয় কাস্টমস হাউসের কর্মরত কর্মচারিদের সাথে, এ সময় তারা জানিয়েছেন, বন্দর থেকে পণ্য খালাশের সময় কাস্টমস কমিশনারের বেঁধে দেওয়া কয়েকটি দপ্তর কাজ করেন।
এ দপ্তরগুলোর মধ্যে পরীক্ষণ, শুল্কায়ন, শুল্ক গোয়েন্দা ও স্যাগ নামের ৪টি দপ্তর উল্লেখযোগ্য। যারা পণ্য পরীক্ষণ ও শুল্কায়নের নামে বিভিন্ন অনিয়ম ও দূর্ণিতী করে দিনকে “রাত” আর রাতকে “দিন” করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। যদি এবিষয়ে দূর্ণীতি দমন কমিশন খোঁজ নেয় তবে তাদের নামে বে-নামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির হিসাব মিলবে।
প্রথমে পরীক্ষণ গ্রুপ পণ্যের ফাইল পরীক্ষা করে ছেড়ে দিলে তা শুল্ক নির্ধারণের জন্য শুল্কায়ন গ্রুপে পাঠানো হয়। আর এই গ্রুপ ২টিতে রয়েছে আলাদা ধরণের ঘুষ। এ গ্রুপগুলোর রয়েছে ঘুষ খাওয়ার ওপেন সিন্ডিকেট নামের নিজস্ব পুল। ধরাবাঁধা নিয়ম অনুসারে পণ্য ছাড় করানোর ফাইল প্রতি পরীক্ষণ পুলে ১ হাজার এবং শুল্কায়ন পুলে দিতে হয় ১ হাজার টাকা। আর যদি ফাইলের এইচএসএস কোডে কোন ফাঁক ফোকড় বা ঘোষণানুযায়ী পণের পরিমাণ বেশী থাকে তাহলে নিলামের ভয় দেখিয়ে সর্বনি¤œ ৫ হাজার টাকা থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নেয় এ দপ্তরগুলোর কর্তারা।
এছাড়া কাস্টমস হাউসের কম্পিউটার শাখায় ফাইল এন্ট্রি বাবদ প্রোগ্রামারকে দিতে হয় ১’শ টাকা। এ সেক্টরে প্রবেশ করতেই প্রোগ্রামার সম্পর্কে আরো তথ্য বেরিয়ে আসে।
ভূক্তভুগিরা জানিয়েছেন, প্রোগ্রামারের হাতে অনেক ক্ষমতা থাকায় এখানকার অনেক ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা তার কাছ থেকে সুবিধা পেয়ে থাকেন। তার পণ্য পরীক্ষণের জন্য কোন কর্মকর্তা নিয়োগ করবেন তা চলিত নিয়মে প্রোগ্রামরকে ১ হাজার টাকা দিলে হয়ে যায়। এই হাজার টাকার বিনিময়ে ব্যবসায়ীরা পছন্দের কর্মকর্তা দিয়ে বন্দর অভ্যন্তরে সরাসরি পণ্যের পরীক্ষণ করাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষণ গ্রুপ থেকে আসেন ১জন সহকারি কমিশনার (এসি) ও ১জন পরিদর্শক। শুল্ক গোয়েন্দা শাখা থেকে আসেন সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা ও কমিশনারের নিজস্ব দল স্যাগ থেকে আসেন ১জন সহকারি কমিশনার (এসি)। এছাড়া প্রত্যেক দপ্তর থেকে সিপাই ও পিয়ন নিয়ে আসা হয়। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের খুশি রাখার জন্য চালু নিয়মে এসিকে ৩ হাজার টাকা, পরিদর্শককে ২ হাজার টাকা, স্যাগের এসিকে ৩ হাজার টাকা, শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরকে ১ হাজার ৫’শ টাকাসহ সাথে আসা প্রত্যেক সিপাইকে ১’শ এবং পিয়নকে ১’শ টাকা করে দিতে হয় ব্যবসায়ীদের।
এছাড়া পণ্যের বিবরণী এইচএসএস কোর্ডের সাথে না মিললে বা পণ্যের পরিমাণ বেশী থাকলে সেখানে জরিমানার নামে সরকারের রাজস্বের পাল্লা ভারি না হয়ে এ কর্মকর্তাদের পকেটের পাল্লা ভারি হয়।
কাস্টমসের সকল নিয়ম মেনে বেলা ৫টার মধ্যে সোনালী ব্যাংকের রিলিজ অর্ডার নিতে পারলে ব্যাংক কর্তাকে দিতে হয় ২’শ টাকা ঘুষ। বিকাল ৫টা পার হলে ৪’শ টাকা। এখানে এটাই চিরাচরিত নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছে।
এরপর শুরু হয় পণ্য পরিবহণের কাজ। এখানেও ডেলিভারী পয়েন্টে পোর্টের বিল তৈরিতে সিডিও বাবদ ১’শ এবং গেট পাশে ১’শ টাকা ঘুষ দিতে হয়। ৫ টার পরে হলে ৫’শ থেকে ৮’শ টাকা। সেড ইনচার্জকে ১’শ টাকা ও বাশ কলে ৩’শ টাকা ঘুষ দিতে হয়।
সঠিকভাবে আমদানিকৃত পণ্যে ঘুষ না দেওয়ার বিষয়ে কথা হয় বন্দর ব্যবসায়ীদের সাথে। এক্ষেত্রে তারা বলেন, ঘুষ ছাড়া ব্যবসায়ীদের কোন গতি নেই। এগুলো ছোট ছোট ঘুষ। বড় বড় কর্মকর্তাদের ঘুষ খাওয়ার নিয়ম আলাদা। এ সকল কর্মকর্তারা আমদানি পণ্যের কেজি প্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা করে মিষ্টি খাওয়ার টাকা নেন।
তবে, এ ব্যাপারে বেনাপোল কাস্টমসের সহকারী কমিশনার (প্রশাসন) রেজাউল করিম আনীত সকল অভিযোগ সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন। তবে ভালো হয় তাদের কমিশনারের বক্তব্য নিলে। কিন্তু কমিশনারের টিএন্ডটি ফোনে ফোন দিলে তা গ্রহণ করা হয়নি।