নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সংরক্ষিত এলাকায় অবাধ যাতায়াত, নিত্য চুরির ঘটনা, চোরাচালান চক্রের দৌরাত্ম্যে, অপরাধীদের বাধাহীন চলাফেরায় দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীল এই স্থাপনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাহজালাল বিমানবন্দর এখন চোরাচালান চক্রের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। আর এই সোনা চোরাচালান ও মুদ্রা পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে তালিকাভুক্ত দাগি অপরাধীরা। এরাই বিমানবন্দর থেকে সোনার চালান বাইরে বের করে নিয়ে আসে। বৈদেশিক মুদ্রা পৌঁছে দেয় বিমানবন্দর পর্যন্ত। যে কোনো ধরনের বাধা বিপত্তি কাটানোসহ নানা কাজে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে থাকে চোরাচালানি চক্র।বিমানবন্দরে এমন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি নজিরবিহীন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশের স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তা নিয়ে সরকার যখন উদ্বিগ্ন, ঠিক তখনই বিমানবন্দরের এমন ভঙ্গুর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে।সূত্র জানায়, অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিমানবন্দরের অভ্যন্তর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, কার্গো ভিলেজে বড় ধরনের চুরির ঘটনা ঘটলেও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এখনো সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা বিভাগের পাস ব্যবহার করে যে কেউ ঢুকে পড়ছেন বিমানবন্দরের সংরক্ষিত এলাকায়। গত এক মাসে বিমানবন্দরের ভিতরে অন্তত ৫টি চুরির ঘটনা ধরা পড়েছে।অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) উপস্থিতির পর বিমানবন্দরের নিরাপত্তাসহ পরিবেশগত অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছিল। তবে চোরাচালানি সিন্ডিকেটের বিরোধিতার কারণেই আর্মড পুলিশ তাদের কর্মকাণ্ড অনেক সংকুচিত করতে বাধ্য হয়েছে। তবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা এবং কাক্সিক্ষত সেবা নিশ্চিতের জন্য সিভিল এভিয়েশন, বিমান এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের কড়া জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা (সিএসও) ইফতেখার হাসান বলেন, বিমানবন্দরে ‘নিরাপত্তা সপ্তাহ’ পালন করা হয়েছে গত মাসে। সেই সময়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। নিরাপত্তা পাসের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে শতাধিক পাস জব্দ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভুয়া নিরাপত্তা পাস ও ডি-পাস (ডিউটি পাস) ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের পাস দিয়ে হ্যাঙ্গার গেট, এয়ারফ্রেইড গেট, কার্গো ভিলেজ গেটসহ বিভিন্ন গেট ব্যবহার করে প্রতিদিন শত শত অবৈধ অনুপ্রবেশকারী অ্যাপ্রোন (যেখানে বিমান দাঁড়ানো থাকে বা অবস্থান করে থাকে) এলাকায় অবাধে ঢুকে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, বিমানবন্দরে সার্বক্ষণিক ২৯টি সংস্থা কাজ করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে বিমান, সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, এপিবিএন, এসবি, ডিবি, র্যাব এবং বিভিন্ন এয়ারলাইন্স ও সংস্থা। তারা ডিউটি চলাকালে সিএএবি নিরাপত্তা পাস ও ডি-পাস ব্যবহার করে থাকে। আর এসব পাস ইস্যু করে সিএএবি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই সিএএবি কর্তৃপক্ষের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অবৈধ নিরাপত্তা পাস ও ভুয়া ডি-পাস ব্যবহার করে প্রতিদিন শত শত লোক প্রবেশ করছে। বিমানবন্দর সূত্র জানায়, সম্প্রতি ১০০ কেজি হেরোইন পাচারের ঘটনায় বিমানবন্দর থেকে কার্গো ভিলেজ এভিয়েশন ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসের স্ক্যান মেশিন অপারেটর কুদরত এলাহি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এ ছাড়া কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাভর্তি ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে গেছেন সিভিল এভিয়েশনের বোর্ডিং ব্রিজ অপারেটর কামরুল হাবিব। কুদরত এলাহি বা কামরুল হাবিবই নন, নানা অপরাধে জড়িয়ে গ্রেফতার হন ১০ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। নিরাপত্তা বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর একটি সেমিনারে বলা হয়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের নাজুক বিমানবন্দরগুলোর একটি। দুর্বল নিরাপত্তার কারণে বিমানবন্দরটি জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস এবং বিমানের কর্মকর্তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কাজে জড়িত হয়ে পড়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে গেছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি রয়েছে। এখানে যে কেউ একটি তদারকি ও পর্যবেক্ষণ ছাড়াই সহজে প্রবেশ এবং বেরিয়েও যেতে পারে। সারা বিশ্বেই এখন বিমানবন্দরগুলো সন্ত্রাসীদের প্রধান লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে। সুতরাং বিমানবন্দরের শিথিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাশকতার সুযোগ সৃষ্টি করবে।বিমানবন্দর এপিবিএন-এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন জানান, বিমান বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। এপিবিএন পুলিশ বিমানবন্দরে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিমানবন্দরের পরিবেশ নিয়ে অনেক প্রশংসা পাচ্ছি। তবে কর্তৃপক্ষ চাইলে এপিবিএন আরও দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। যে কোনো ক্রাইসিস মুহূর্তে কাজ করার জন্য এপিবিএন’র সদস্যরা সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে। –