সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, বিচারপতি মরহুম হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘দেশ এখন বাজিকরদের হাতে।’ টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, দখলবাজ, তদবিরবাজ, মতলববাজ ধরনের বাজিকরদের হাতে আসলেই দেশ। না হয় এ রকম বৈরী পরিস্থিতির মুখেও প্রশাসনের একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী রাতের আঁধারে লুকোচুরি করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার গুলশানের বাসভবনে দেখা করেন? মিটিং করেন? প্রশাসন কেন দলবাজি করে? এই প্রশ্ন সবসময় মাথায় ঘুরপাক খায়। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনকে নেতৃত্ব ও দক্ষতার গুণে যারা মহিমান্বিত করেছিলেন সেসব বরেণ্য আমলার অনেকেই ইন্তেকাল করেছেন। অনেকে এখনো জীবিত আছেন। কিন্তু আর যাই হোক প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তারা সংবিধান, আইন ও বিধি-বিধান মোতাবেক নিজেদের ক্যারিশমায় প্রশাসনকে গতিশীল রেখেছেন। তারা আমলাতন্ত্রের নিয়মে বাঁধা জীবনে সরকারের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য দেখালেও নিজেদের ব্যক্তিত্বকে বিক্রি করে দেননি দাসত্বের শৃঙ্খলে। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য থাকতে পারে, কারও কারও বিরুদ্ধে গণবিরোধী চরিত্র ফুটে উঠতে পারে কিন্তু তারা কেউই পিঠে গ্লানির দলবাজির সিল নিয়ে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড করেননি। ’৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছরের সংগ্রাম শেষে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার পর তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পুনর্মিলনী সভায় বলেছিলেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে আমরা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে রাখব। আমরা চাইব মেধার ভিত্তিতে আমাদের সন্তানরা সেখানে পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে উত্তীর্ণ হবে। সেদিন ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের সঙ্গে মঞ্চে বসা তোফায়েল আহমেদ বিব্রত হলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা পরিষ্কার বলেছিলেন, দলীয় নিয়োগ জাতিরও কাজে আসে না, দলেরও না। তোফায়েল ক্যাডার দিয়ে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। অবসরপ্রাপ্ত সচিব আবু আলম শহীদ খান তখন ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি। একটা উন্মুক্ত সভায় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর সামনে দেওয়া সেই বক্তৃতার অংশটি না ছাপানোর জন্য তিনি এসে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছিলেন, ‘এটি অফ দ্য রেকর্ড’। আমি তখন মতিউর রহমান চৌধুরী সম্পাদিত বাংলাবাজার পত্রিকার রাজনৈতিক রিপোর্টার। আবু আলমের অনুরোধ সেদিন না রাখলেও একটি দলের প্রতি দরদি অনেক সংবাদকর্মী সেই অনুরোধ রেখেছিলেন। অনেক পত্রিকায় পরদিন এই বক্তব্যটি ব্লাকআউট হয়ে যায়। কিন্তু আমি উপলব্ধি করেছিলাম দুটি বিষয়। এক. দেশের প্রধানমন্ত্রী উন্মুক্ত সভায় যে বক্তৃতা করেছেন সেটি অফ দ্য রেকর্ড হয় কীভাবে? এমনিতেই অফ দ্য রেকর্ডকে আমি মিডিয়া স্বীকৃত প্রহসন মনে করি। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সেই কথা ছিল দেশের একজন অভিভাবকসুলভ নেতৃত্বের কথা। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের তালিকায় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল- এমন খবর এখন ইতিহাসের অংশ। এটি তখনো জাতীয় জীবনে আলোচিত ঘটনা ছিল। সেসব ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা রাষ্ট্র পরিচালনায় মূলত সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদের জমানায় সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য দেখিয়ে তাদের পেশাদারিত্বের দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। প্রশাসন পরিচালনায় তাদের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। সেনাশাসকরাও প্রশাসনকে তাদের প্রহসনের নির্বাচন এবং পরবর্তী রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যবহার করেছেন। প্রকাশ্যে গণরায় ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা এসব কর্মকর্তার মধ্যে থাকা জেলা প্রশাসকদের সামনে ঘটেছে। ’৯১-এর বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামল এবং ’৯৬ সালে শেখ হাসিনার জমানায় প্রশাসনকে নিয়োগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে দলীয় ছাপ দিয়ে কাজ করানো হয়নি। ’৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের এক পর্যায়ে ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফের ডাকে জনতার মঞ্চে গণমানুষের ঢল নামলেও কেউ ভাবতে পারেননি একটি রাজনৈতিক শক্তির আন্দোলনের প্রতি এভাবে সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তারা সমর্থন জোগাবেন। সেদিন ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশ মিছিল করে জনতার মঞ্চে এসে সংহতি জানিয়েছিলেন। সেই থেকে প্রশাসন প্রকাশ্যে দুটি পথ নেয়। কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি এ নিয়ে প্রশাসনের ভিতরে-বাইরে তুমুল আলোচনার ঝড় তোলে। ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে প্রশাসনের রাজনৈতিক বিভক্তি প্রকট হয়ে ওঠে। এমনকি পুলিশসহ সিভিল প্রশাসনে বিসিএসের মাধ্যমে দলীয় লোকদের নিয়োগ দিতে বিএনপির নির্বাসিত নেতা তারেক রহমানের হাওয়া ভবন মুখ্য ভূমিকা রাখে। আওয়ামী লীগ সিল থাকার অভিযোগে অনেক সরকারি কর্মকর্তা মেয়াদপূর্তির আগেই অবসরে যান। অনেককে প্যাকেজ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওএসডি করে। ২০০৬ সালে এসে বিএনপি সরকার ফের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে দলীয় আজ্ঞাবহদের দিয়ে তিন স্তরের প্রশাসন সাজায়। সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে ক্লাব স্যান্ডুইচ প্রশাসন স্তর সাজানো বিএনপি হেরেমের ষড়যন্ত্রকারীরা ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে প্রশাসনের নগ্ন নৃত্যের তালে তালে ক্ষমতায় ফিরতে চেয়েছিল। সেদিন রাতের আঁধারে উত্তরায় আজকের কারাবন্দী মাহমুদুর রহমানের উদ্যোগে বিএনপির অনুগত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গোপন বৈঠক করেছিলেন। আজকের মতো সেদিনও গণমাধ্যম সেই উত্তরা ষড়যন্ত্র প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সেই সহিংস রাজনীতি ও দলীয়করণের অশুভ করুণ পরিণতিতে নির্বাচনটি বাতিল হয়ে যায়। দেশে ওয়ান-ইলেভেনের আবির্ভাব ঘটে। বড় বড় স্বপ্নের ফানুস বেলুনের মতো চুপসে যায়। ওয়ান-ইলেভেন ব্যর্থতার চোরাবালিতে ডুবে যায়। কুশীলবরা পার পেয়ে যান। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরা চড়া মাশুল দেন। দেশ অনেক পিছিয়ে যায়। প্রকাশ হয় এর নেপথ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাজনীতি আলোর মুখ দেখলেও সেই সময়কার ইতিহাস থেকে পাঠ নেওয়া চেতনার জায়গাটি শক্ত ভিত্তির ওপর আর দাঁড়াতে দেখা যায়নি। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ অনুরাগী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নতুন করে সংগঠিত করা হয়। ক্ষমতায় আসার পর দলীয় আজ্ঞাবহরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আলোয় প্রশাসনের শোভাবর্ধন করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন। উদ্ভিদ লতার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে তাদের প্রমোশন ঘটে। কপালে ঘটে ভালো ভালো পদোন্নতি ও বদলির ঘটনা। অন্যদিকে বিএনপির প্রতি অনুগতরা শয়ে শয়ে ওএসডি হয়ে পড়ে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নিয়োগ পান যুবলীগ নেতা! প্রশাসনের দলীয়করণ ও বিভক্তির রাজনীতির লোকসান গুনতে হয় রাষ্ট্রকে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় অনেক দক্ষ কর্মকর্তাকেও কাজ ছাড়া পুষে যায় সরকার। বিভক্তির রাজনীতি কার্যত গোটা জাতিকেই বিভক্ত করে রেখেছে। মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী, দলীয় দাসত্বের বিরোধী মানুষেরা কী সমাজ, কী প্রশাসন- সর্বত্র দুটি ধারার কাছ থেকে উপেক্ষিত। বিএনপির প্রতি অনুগত একদল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যেভাবে বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন, বৈঠক করেছেন, তা নিয়ে দেশজুড়ে ঝড় উঠেছে। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা অবশ্যই তার দলের প্রতি অনুগত থাকবেন। দেশের যে কোনো নাগরিক যে কোনো দলকে প্রকাশ্যে বা গোপনে সমর্থন দিতে পারেন। প্রশাসনের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আর যাই হোক সংবিধান, আইন, বিধি-বিধানের কাছে দায়বদ্ধ। পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে তারা সরকারের প্রতি অনুগত থাকবেন। কিন্তু কোনো দলের প্রতি জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন-ভাতা পাওয়া কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্দিষ্ট দলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে পারেন না। যারা দেখান তারা সংবিধান, আইন ও পেশাদারিত্বের চেতনাকে লঙ্ঘন করেন। জাতীয় জীবনে দলবাজির যে নগ্ন প্রকাশ ঘটছে তার অশুভ ছায়া থেকে প্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বের করতে না পারলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের বদলে দলের খাদেমে পরিণত হবে। জাতীয় নেতৃত্বকে উপলব্ধির মাধ্যমে এই অসুস্থ সিরিজ নাটক বন্ধে সংবিধান, আইন ও বিধি-বিধান সামনে রেখেই মূল্যবোধের জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখনই সময়।