অপারেশনে ত্রুটি থাকায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে অন্ধ হতে বসেছেন সাতজন রোগী। এ তালিকায় রয়েছেন একজন চিকিৎসকও। চোখের ছানি অপারেশন করতে ভর্তি হয়েছিলেন তারা। অপারেশন সফল হলেও ব্যান্ডেজ খোলার পর কেউ চোখে দেখছেন না। গত সাত দিন এই অবস্থা চলতে থাকলেও ঊর্ধ্বতন মহল থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ওই সাত রোগী ও তার স্বজনেরা। প্রথম অপারেশনের পর আরো দুইবার অপারেশন করা হলেও অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। কী কারণে এক সাথে সাতজনের অপারেশনে ত্রুটি দেখা দিলো সে ব্যাপারে কোনো ডাক্তার মুখ খুলতে চাইছেন না। এমনকি যারা এ সাতজনের চোখের অপারেশন করেছেন তাদের নাম পরিচয়ও গোপন করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ দিকে চোখ হারানোর ভয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন সাত রোগী। ভুক্তভোগীদের মধ্যে তেজগাঁও ন্যাশানল ইনস্টিটিউটের ডেপুটি ডাইরেক্টর পদে কর্মরত একজন চিকিৎসক আছেন।
গতকাল সরেজমিন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে গিয়ে কথা হয় চোখ হারাতে বসা এসব রোগীর সাথে। তারা হলেনÑ তেজগাঁও ন্যাশানল ইনস্টিটিউটের ডিডি ডা: মো: মোসাদ্দেক (নাক, কান গলা বিশেষজ্ঞ), আবুল কালাম (৬৫) আইনুল হক (২৬), আলেয়া বেগম (৫৭) ও সেলিনা বেগম (৩০)। তবে দুইজন রোগী ওই অবস্থায় নিজ নিজ বাসায় চলে গেছেন। তারা আবার আসবেন বলে সহরোগীদের জানিয়েছেন। বাকি পাঁচজনকে ইনস্টিটিউটের পঞ্চম ফোরের পাশাপাশি কেবিনে রাখা হয়েছে। তবে ডা: মোসাদ্দেককে রাখা হয়েছে অপর ব্লকে। ৬৪০ নম্বর কেবিনে থাকা আবুল কালাম জানান, তার চোখে ছানি পড়ায় কম দেখতে শুরু করেন। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা বলেন, চোখে ছানি হয়েছে। অপারেশন করে ফেলো। আজ-কাল ছানি অপারেশন খুব সহজ কাজ। মাত্র এক দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। আবার অনেকে থাকে না। এ অপারেশনটা হলে তোমার চোখ ভালো হয়ে যাবে। সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাবে। তাদের কথায় রাজি হয়ে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন আবুল কালাম। কিন্তু অপারেশন কোথায় করাবেন। এ ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত দেন। তবে অনেকেই বলেন, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হচ্ছে সব থেকে ভালো যায়গা। কারণ এখানে দেশের সব থেকে বড় বড় চিকিৎসকেরা আসেন। গবেষণা করেন। ওই সব বড় চিকিৎসকদের কাছ থেকে অপারেশন হলে অনেক ভালো হবে। এর পরের কথাটি বলার আগেই কেঁদে ফেলেন আবুল কালাম। তার শরীর কাঁপতে শুরু করে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ভালো চিকিৎসকেরা আমার এমন অপারেশন করেছেন যে এখন আমি চোখেই দেখতে পাই না’। তিনি বলেন, শুধু আমার চোখে অসুবিধা হলে বুঝতাম আমার ভাগ্য খারাপ। আমার সাথে ওই দিন যে সাতজনকে অপারেশন করা হয়েছে তারা কেউ চোখে দেখছেন না’। এটা অবশ্যই চিকিৎসকদের ভুল। কিন্তু তারা কিছুই স্বীকার করছেন না। উল্টো বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন টালবাহানা করছেন।
তিনি বলেন, গত ২ তারিখে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক জালাল আহমেদের অধীনে ভর্তি তিনি। পর দিন সকালে তার অপারেশন হওয়ার কথা। ডান পাশের চোখ অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় চেষ্ট করানো, লেন্স ও ওষুধ কেনা সম্পন্ন করা হয়। ৩ তারিখ সকালে তাকে তৃতীয় তলার অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। তখন দেখেন আরো ছয়জনকে অপারেশনের জন্য তৈরি রাখা হয়েছে। এরপর একে একে সাতজনের চোখ অপারেশন করা হয়। তিনি বলেন, অপারেশনের সময় তেমন কোনো অসুবিধা হয়েছে বলে তার মনে হয়নি। কিন্তু অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে ওই চোখে আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। একে একে জানতে পারেন তার সাথে যে সাতজনকে অপারেশন করা হয়েছে তারা কেউ চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। তখন বিচলিত হয়ে পড়েন তারা। খবর পেয়ে চিকিৎসকেরা ছুটে আসেন তাদের কাছে। তারা সব কিছু দেখে নিজেরা কী সব আলাপ করতে থাকেন। এরপর চলে যান।
ডাক্তারদের কানাঘোষা দেখে রোগীর আত্মীয়স্বজনরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিষয়টি জানা হয়ে যাওয়ার ভয়ে কিছু সময় পর হাসপতালের কর্মচারীরা তাদের ওয়ার্ড থেকে কেবিনে নিয়ে যায়। তিনি জানতে চান, আমাদের একদিন থাকার কথা তাহলে কেবিনে নিচ্ছেন কেন। এ ব্যাপারে কর্মচারীরা তাদের কিছুই জানাতে পারেননি। পরে একজন চিকিৎসক তারে বলেন, ‘একটু সমস্যা হয়ে গেছে আপনাদের আবার অপারেশন করতে হবে’। আবুল কালাম জানান, এভাবে তিনবার অপারেশন করা হয় তাদের।
সিলেট থেকে আসা আইনুল হক বলেন, ২৬ বছর বয়সেই তার চোখে ছানি দেখা দেয়। ভালো চিকিৎসার জন্য তিনি সিলেট থেকে এসে চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ডান চোখে অপারেশন করা হয়। কিন্তু এ কী হয়ে গেল। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, এই বয়সে যদি চোখ হারাতে হয় তাহলে কিভাবে চলবেন। আইনুলকে রাখা হয়েছে ৬৩৪ নম্বর কেবিনে। তিনি আরো বলেন, এখন চিকিৎসকেরা আসছেন আর মুুহূর্তে ওষুধ বদলাচ্ছেন। কখন বলছেন এটা আনেন। সেটা আনলে আবার বলছেন এটা চলবে না। আর একটা আনতে হবে। সবই করা হচ্ছে কিন্তু চোখ ভালো হচ্ছে না।
আবুল কালামের ছেলে আবদুল্লাহ-আল-মামুন নয়া দিগন্তকে বলেন, কেন এমন হলো জানতে চাওয়া হলে ডাক্তারা তাদের বলছেন, ‘অপারেশন থিয়েটারে ভাইরাস ছিল। ওই ভাইরাসের কারণে তাদের চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। পরবর্তী অপারেশনগুলোয় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে চোখ ভালো হয়ে যাবে। তবে যত দিন ভালো না হয় তত দিন তাদের চিকিৎসা দেয়া হবে বলেও তারা জানিয়েছেন। ভুক্তভোগী চিকিৎসক মোসাদ্দেক বলেন, ‘আমি একজন চিকিৎসক। আমি কী বলব বা বলা উচিত তা বুঝে উঠতে পারছি না। তবে আমাদের জন্য দোয়া করবেন। যাতে সেরে উঠতে পারি। আর কিছুই বলতে রাজি হননি তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে ইনস্টিটিউটের পরিচালক জালাল উদ্দিনের রুমে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে জরুরি বিভাগের দায়িত্বে থাকা ইএমও ডাক্তার আবদুল্লাহ আল মুরাদ বলেন, ঘটনাটি সেনসেটিভ। এ ব্যাপারে কথা বলার এখতিয়ার তার নেই। সিনিয়র স্যারদের (আবাসিক সার্জন) সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন তরিকুল ইসলামের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি অপর আবাসিক সার্জন শ্যামল কুমার সরকারের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু শ্যামল কুমার সরকারের সাথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকেও পাওয়া যায়নি।
post by Usman gony