পশুর নদের পাশে বেড়িবাঁধের প্রায় শেষ প্রান্তে খালি হাতে তেল তুলছিলেন শাহ আলম মাতবর (৪০)। পা থেকে বুক পর্যন্ত কালো তেলে মাখামাখি। কথা বলতে চাইলে খানিকটা রসিকতা করেই বললেন, ‘আগে মাছ ধরতাম ভাই। এখন ত্যাল ধরি।’ একই সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে নদীতে মাছ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করে তিনি বললেন, ‘মাছ কমলি তো বিপদ। মাছ নেই তো আমরাও নেই।’
গতকাল শনিবার জয়মণি এলাকার নদীতীরবর্তী মানুষ এবং অন্তত ৫০ জন জেলে ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা যেসব নদী ও খালে মাছ ধরতেন, সেগুলোতে মাছ ও কাঁকড়ার পরিমাণ কমে গেছে। কোথাও কোথাও ভেটকি, পারসে এবং বাটা মাছের বাচ্চাসহ অনেক ছোট মাছও মরে ভেসে উঠতে দেখেছেন তাঁরা। জীবিকার তাগিদে নদী থেকে তেল সরিয়ে যাঁরা জাল পেতেছিলেন, তাঁদের জীবিকার একমাত্র সম্বল জালগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নদীতে ভাসমান তেল অপসারণে কাজ করা অনেকের শরীরে জ্বলুনিসহ চুলকানির সমস্যাও দেখা দিয়েছে।
জয়মণিঘোলের কাছে শ্যালা নদী যেখানে পশুরে মিশেছে, সেখানকার বাঁধের দুপাশে অন্তত সাড়ে তিন শ জেলে পরিবারের বাস। এখানেই কথা হলো ষাটোর্ধ্ব রওশন ফকিরের সঙ্গে। গত ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে যিনি মরা পশুর, শ্যালা নদীর মৃগমারী, আন্ধারমানিকসহ বনের বিভিন্ন খালে মাছ ধরেন। তাঁর ভাষ্য, আগে প্রতিদিন যেখানে চার থেকে পাঁচ কেজি বিভিন্ন রকমের মাছ তাঁর জালে ধরা পড়ত, এখন তা দেড়-দুই কেজিতে নেমে এসেছে। পাশে থাকা আরেক জেলে সুলতান আলী শেখ জানালেন, ট্যাংকারডুবির দুদিনের মাথায় দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মাছ ধরতে গিয়েছিলেন পশুর নদের পশ্চিম পারে বড় কুইঞ্চা খালে। ‘আমরা তিন বাপ-ব্যাটা চাইর ঘণ্টা চেষ্টা করিও একটা মাছ পাইনি। গোটা খালে খালি দুডো মরা পাতাড়ির (ভেটকি) পুনা ম্যরি পড়ি থাকতি দ্যাখলাম।’ বললেন সুলতান আলী।
এলাকার জেলেরা জানান, তাঁদের অনেকেই বনের ভেতরের খালগুলোতে ভেটকির পোনার মতো পারসে ও বাটা মাছের পোনাও মরে ভেসে থাকতে দেখেছেন।
বাঁধের ওপরে জেলেপল্লির শুরুর পথেই হালিমা বেগমের ঘর। যাঁর স্বামীও একজন মৎস্যজীবী। আক্ষেপ করে হালিমা বললেন, ‘আমরা মাছ-কাঁকড়া ধরি খাই। এক দিন নদীত না খাটলি আহার আসে না। দুদিন বাদে কাইলকি নদীত গে তিনডি কাঁকড়া পাইছি। তাও গায়ে মফিল (তেল)। ডিপুতে নে গেলি কয়িছে যে এ কাঁকড়া বিককির হবে না।’
শাহ আলমের ঘরের পাশে পায়ে দড়িবাঁধা তেলমাখা দুটি নির্জীব হাঁস দেখা গেল। এ সময় একজন বৃদ্ধা বলে উঠলেন, ‘নদীত নামছিল। তেল ম্যেখি মরার কোল দি ফিরিছে।’ হাঁসটির শরীর তেলমুক্ত করতে গরম পানি দিয়ে ধোয়ানো হয়েছে। এ সময় আশপাশে থাকা অনেকেই জানালেন, খালি হাতে-পায়ে তেল তোলার ফলে তাঁদের চুলকানি ও জ্বলুনির মতো সমস্যা হচ্ছে।
নাতি কোলে মিলনমালা (৫০) বললেন, ‘নদীই তো আমাগের সব। আমরা নদীর পানি খাই। গোছল করি। এখন ২০ টাকার পানি আনতি পাঁচ টাকার পথ যাতি হয়। কাপড় কাচা বাদ। মানুষির পুকুরি গোছল করতি হাত-পাও ধরা লাগে।’
জেলেপল্লি থেকে বেরিয়ে জয়মণি বাজারের দিকে আসার সময় কথা হচ্ছিল মোটরসাইকেলের চালক তরিকুলের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘এ সময় নদীর ধার দি অনেক বাটা মাছের পুনা লাফাতি দ্যেখা যাতো। আমার বাপ ন হাজার টাকা খরচ করি বাটা মাছের পুনা ধরার জন্যি জাল কিনিলো। কিন্তু তেল ভ্যেসি জালও শেষ, পুনাও শেষ।’
এ সময় বন ঘুরে আসা প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যবিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থও বললেন, তিনিও বনের ভেতর একটি সাপ ও মেদ মাছ নির্জীব পড়ে থাকতে দেখেছেন। এলাকার নদীগুলোতে মরে ভেসে ওঠা মাছ ও এর পরিমাণ কমে যাওয়ার বিষয়ে আশঙ্কার কথা জানালেন মংলা বাজার মৎস্য আড়তদার কল্যাণ সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক মো. ইলিয়াস হাওলাদার।
তেল অপসারণে অর্ধশতাধিক ট্রলার-নৌকা: ছড়িয়ে পড়া তেল অপসারণে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি গতকাল সকাল থেকে বন বিভাগের অর্ধশতাধিক ট্রলার ও নৌকা কাজ শুরু করেছে। গতকাল দুপুরে চাঁদপাই বনফাঁড়ির জয়মণি লঞ্চঘাট এলাকায় পদ্মা অয়েল কোম্পানির তেল ক্রয়ের পয়েন্টের সামনে গিয়ে দেখা যায়, এসব নৌকা-ট্রলারে করে ছড়িয়ে পড়া তেল ছাড়াও কালো তেল মাখানো কচুরিপানা, ভেসে আসা কাঠসহ বিভিন্ন বর্জ্য নদী ও খালগুলো থেকে তুলে আনা হচ্ছে।
ওই সময়ে দুর্ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করে সেখানে উপস্থিত হন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তাঁর সঙ্গে বন বিভাগ ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারাসহ মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় সেখানে থাকা পদ্মা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, তিনটি পয়েন্ট থেকে তখন পর্যন্ত সর্বমোট নয় হাজার ৪০০ লিটার তেল কিনেছেন তাঁরা। দিন শেষে এর পরিমাণ ২০ হাজার লিটারে পৌঁছাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত তেল অপসারণে রাসায়নিক নিয়ে আসা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কান্ডারি-১০ টাগবোটটিকে অলস বসে থাকতে দেখা গেছে।
post by Usman gony