সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যালা নদীতে একটি তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তেলের প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে পরিবেশে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পরিবেশ বিপর্যয় এবং জনদুর্ভোগেরই এক ক্ষুদ্র চিত্র।
সুন্দরবনের জেলেদের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থাটি জানিয়েছে, নদী ও খালে তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে গত কয়েকদিন ধরে কাঁকড়া ও মাছ না পাওয়ায় তারা জাল ফেলা বন্ধ রেখেছেন। বর্তমানে তারা দুশ্চিন্তার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।
দশ বছরেরও বেশি সময় সুন্দরবনের জয়মনি এলাকায় মাছ ধরছেন ইমরান শেখ।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, শীত হলো কাঁকড়া, কাইন মাছ, ভেটকি ও পাঙাশের মৌসুম। তেল ছড়িয়ে পড়ার পর মাছ পাওয়া যাচ্ছে না তাই সবার মাছ ধরা বন্ধ। মাছের পরিবর্তে বর্তমানে জেলেরা তেল সংগ্রহেই ব্যস্ত আছেন।
তার ভাষায়, জেলেরা পানি থেকে তেল সংগ্রহ করে নিজেদের ভবিষ্যৎ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, এই তেল নদীতে থাকলে তো মাছ ধরা পুরোটাই বন্ধ হয়ে যাবে। সারা বছর আমরা কি খাব?
সাধারণ সময়ে ঐ এলাকায় একজন জেলে দিন প্রতি কমপক্ষে পাঁচশ টাকার কাঁকড়া বা হাজার খানেক টাকার মাছ সংগ্রহ করতে পারেন।
ইমরান শেখ বলেন, এখন পানির নিচে কিছু আছে কিনা তো বোঝার কোন উপায় নেই।
ভবিষ্যতে কি হবে তাই সে নিয়ে দুশ্চিন্তায় তার মতো আরো অনেক জেলে।
তবে গত ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় খুলনা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, আমি বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি, এতে তেমন ক্ষতি হবে না। ফার্নেস অয়েলের বদলে ডিজেল বা পেট্রোল হলে অনেক ক্ষতি হত। ফার্নেস অয়েলের রাসায়নিক ক্ষতিকর প্রভাব কম।
তিনি আরো বলেন, এছাড়া এখন বর্ষাকাল হলে নদীর জোয়ার বেশি হত এবং তেল বেশি অঞ্চলে ছড়িয়ে তাতে আরো বেশি ক্ষতি হত। তবে তা না হওয়ায় তেমন ক্ষতি হবে না।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ফার্নেস তেল হলো কম সান্দ্রতা (viscosity) সম্পন্ন এক প্রকার পেট্রো ক্যামিকেল পদার্থ যা সাধারণত শিল্প কারখানার বয়লার ও বাসা-বাড়ি গরম রাখার জ্বালানি হিসাবে শীত প্রধান দেশে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। পানিতে ভাসমান তেল কণা ম্যানগ্রোভ বনের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। নদীর পানিতে ছড়িয়ে পড়া তেল পানির উপর পাতলা একটি আস্তর তৈরি করবে যা ভেদ করে সূর্য রশ্নি পানির আভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে না ফলে জুয়ো প্ল্যাঙ্কটন নামক ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রধান খাদ্য ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন নামক ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া বাঁধা গ্রস্ত হবে। ফলে জুয়ো প্ল্যাঙ্কটন হলো ছোট মাছের প্রধান খাদ্য। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের অভাবে জুয়ো প্ল্যাঙ্কটনের পরিমাণ কমে যাবে; জুয়ো প্ল্যাঙ্কটনের অভাবে ছোট মাছের সংখ্যা কমে যাবে; ছোট মাছের অভাবে ঐ এলাকার বড় মাছ ও ডলফিনের খাদ্য সংকট দেখা দেবে। পানির উপরস্থ তেলের স্তর ভেদ করে বাতাসের অক্সিজেন পানিতে দ্রবীভূত হতে পারবে না ফলে নদীর তলদেশে অক্সিজেন শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হবে ও কাদায় বসবাস কারি প্রাণী মারা যেতে পারে।
ম্যানগ্রোভ বনের উদ্ভিদগুলো সুমদ্রের জোয়ার-ভাটা পরিবেশে অভিযোজিত ও মাটির উপরে উঠে আসা মুলে লেনটিসেল নামক এক প্রকার ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে যার মাধ্যমে বায়ু থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে থাকে। শ্বাসমূলীয় বৃক্ষের লেনটিসেল বন্ধ হয়ে গেলে তার মৃত্যু অবধারিত।
অপরদিকে দুর্ঘটনার ফলে ছড়িয়ে পড়া তেল নদী ও নদীর দুই পাশে বসবাসকারী প্রাণী সম্পদ যেমন: মাছ, ছোট মাছের প্রধান খাদ্য প্ল্যাঙ্কটন, মাছের উপর নির্ভরশীল পাখী, ভোঁদড় ইত্যাদি প্রাণীর উপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। যেহেতু শীত কাল শুরু হয়ে গিয়েছে তাই পাখির শরীরে তেল জড়িয়ে যাওয়ার কারণে হাইপোথারমিয়া হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ছড়িয়ে পড়া তেল মাছের উপর নির্ভরশীল পাখী যেমন: মাছ রাঙ্গা, পানকৌড়ি সহ বিভিন্ন প্রকার বকের পাখনায় জড়ালে ডানা ভারী হয়ে সেই পাখি উড়ার শক্তি হারাবে। ফলে সহজেই অন্য প্রাণী দাঁরা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাবে। ভোঁদড়; বাঘ, বাণর ইত্যাদি প্রাণীর গায়ে তেল জড়ালে সেই প্রাণী গুলো নিজের জিভ দিয়ে তা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবে; এর ফলে তেলের একটা অংশ পেটের ভিতরে চলে যাবে ও বিষক্রিয়ার আক্রান্ত হবে। বেশি পরিমাণ তেল পেটে প্রবেশ করলে মৃত্যু অনিবার্য। একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, তেল দুর্ঘটনা সংঘটিত এলাকার প্রাণী সম্পদের প্রজনন ক্ষমতা শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পায় এবং পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে ৩ থেকে ৫ বছর লাগে।
প্রসঙ্গত, গত ৯ ডিসেম্বর ভোর ৫টার দিকে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় সাড়ে তিন লাখ লিটার জ্বালানি তেলসহ ‘ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন’ নামে একটি ট্যাংকার ডুবে যায়। ওই এলাকার জয়মনি, বেলতলা, নন্দবালা, আন্ধারমানিক, মৃগমারী প্রভৃতি এলাকার নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ে।
সেসময় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত জানান, এত পরিমাণ তেল পানিতে ভেসে থাকায় উপকূলীয় প্রাণি বৈচিত্র্যের ওপর এর মারাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বনের গাছপালা শ্বাসমূল দিয়ে অক্সিজেন নেয়। এই তেলের আস্তর জোয়ারের সময় মাটির ওপরে বিস্তৃত হলে গাছের শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত করবে। ফলে গাছ মারা যাবে।
ডুবে যাওয়া ট্যাংকারের মালিকপক্ষের বরাত দিয়ে সেসময় মংলা কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের কনটিনজেন্ট কমান্ডার মাসুদ জানান, গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে সোমবার ০৮ ডিসেম্বর বিকালে রওনা হয়েছিল জাহাজটি। রাতে জাহাজটি চাঁদপাই রেঞ্জের জয়মনি ঘোলের কাছে শেলা নদীতে নোঙর করে ছিল। ভোর ৫টার দিকে ঘনকুয়াশার মধ্যে আবার যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে ‘টোটাল’ নামের একটি খালি কার্গো জাহাজ পেছন থেকে সাউদার্ন স্টারকে ধাক্কা দেয়। এতে সাউদার্ন স্টারের একপাশের খোল ফেটে যায় এবং জাহাজটি তলিয়ে যায়।
তিনি জানান, টোটাল নামের কার্গো জাহাজটি মংলা বন্দরে পণ্য খালাসের পর চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিলো