পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বের হয়ে সরকার পতনের আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতির কর্মযজ্ঞ শুরু করছে বিএনপি। ডিসেম্বরকে ‘ওয়ার্ম-আপের’ মাস হিসেবে বেছে নিয়ে সরকারকে চতুর্মুখী চাপে ফেলে দাবি আদায়ের ছক অাঁকছে দলটি। আগামী জানুয়ারিকে টার্গেট করে হাতে নেয়া চূড়ান্ত কর্মসূচিতে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা চলছে। এর ধারাবাহিকতায় আজ ‘ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ কনভেনশনে থেকে বেশকিছু সিদ্ধান্ত আসবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
সকাল ১০টায় রাজধানীর রমনায় অবস্থিত ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে অনুষ্ঠিত এ কনভেনশনে প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানের সভাপতিত্বে কনভেনশনে ‘৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতারা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া বর্তমান ও সাবেক ছাত্রদলের নেতারাও অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ‘ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ গড়ে যারা ওই সময় গণতন্ত্র উদ্ধার করেছিলেন সময়ের প্রয়োজনে আরেকটি সংগ্রামের শপথ নিতে যাচ্ছেন তারা। নব্বইয়ে সস্নোগান ছিল ‘স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্রের মুক্তির’। এবারে সস্নোগান ‘ফ্যাসিবাদের পতন ও গণতন্ত্র মুক্তির দ্বিতীয় লড়াই’।
জানা গেছে, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ও বর্তমান নেতারা এই কনভেনশনে অংশ নিচ্ছেন। প্রায় সাড়ে তিন হাজার ছাত্র নেতার জমায়েত হবে এই মঞ্চে। ১৯৯০ সালের ১ অক্টোবর যেমন জমায়েত হয়েছিলেন তেমনি আরেকটি কনভেনশন করতে চান উদ্যোক্তারা। এর ফলে তখন যেমনটি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। এবারের কনভেনশনে বর্তমান সরকারের পতনের আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট হবে বলে মনে করছেন আয়োজকরা।
এছাড়া মাসজুড়ে চলবে নানা ওয়ার্ম-আপ কর্মসূচি। যার মধ্যে আছে- সদস্য সংগ্রহ, বেগম জিয়ার গণসংযোগ, আলোচনা সভা, মতবিনিময় প্রভৃতি। এ বিষয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বৈঠকে বলেছেন, এই বিজয়ের মাস হবে তাদের আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। তারপর জানুয়ারিতে সরকার অপসারণের আন্দোলন হবে।
বিএনপির এসব কর্মসূচিতে বাধা এলে তাৎক্ষণিকভাবে লাগাতার কর্মসূচির দিকে যাওয়ার চিন্তা রয়েছে। অর্থাৎ মার্চে নতুন নির্বাচনের বিষয়টি টার্গেট করে মাঠে নামবে দলটি। এজন্য জানুয়ারির মধ্যে ঢাকা মহানগর বিএনপিকে নতুন রূপে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় হাইকমান্ড। সরকার নতুন বছর থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে হরতাল-অবরোধসহ রাজপথের কঠোর কর্মসূচি দেবে বিএনপি জোট।
জানা গেছে, আগামী ৫ জানুয়ারি থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরে মহাসমাবেশের মাধ্যমে একযোগে রাজপথে নামতে চান বেগম জিয়া। তবে এর আগে ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের দিনকে কালো দিন হিসেবে পালন করতে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি। ওইদিন দেশের জনগণকে কিছুক্ষণের জন্য সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে স্থির অবস্থান নিতে বলতে পারেন খালেদা জিয়া।
অবৈধ সরকারের পতন ঘটবে বলে হুশিয়ারি দিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, শুধু বিএনপি নয় ৫ জানুয়ারিকে এদেশের মানুষও কালো দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ দিনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। কারণ সেটি কোনো নির্বাচন ছিল না। তা ছিল জনগণের সঙ্গে প্রতারণা আর তামাশা। আগামী ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ও স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।
দলের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সহিংসতা নয়, এবার কৌশলীও হচ্ছে বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীন আগাম নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের রোডম্যাপ সাজানোর পাশাপাশি বিচক্ষণ পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। দাবি আদায়ে সাংগঠনিক শক্তিকে একমাত্র মানদ- হিসেবে বিবেচনা না করে কিছুটা রাজনৈতিক বিচক্ষণতার (কূটকৌশল) দিকেও ঝুঁকছেন তারা। এজন্য নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখা বিএনপির প্রথম সারির নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের যুক্ত করা হচ্ছে দলীয় কার্যক্রমে। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১ অক্টোবর ১৯৯০ সালে এ রকমেরই ছাত্র কনভেনশনের আয়োজন করা হয়েছিল। একইরকমভাবে আন্দোলনের বিষয়টি মাথায় রেখে এ ছাত্র কনভেনশনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ওই কনভেনশনে চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিপরীতে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা করবেন নেতারা। তবে এ সর্বদলীয় ছাত্র ফোরামে শরিক জামায়াত ইসলামী সমর্থিত ছাত্রশিবিরকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কিনা তা এখনো নির্দিষ্ট করা হয়নি। এক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের আলোচনায় নেতাদের মনোভাব ও বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সূত্রটি আরো জানায়, বিএনপির নীতিনির্ধারকরা এক প্রকার ধরেই নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে সংলাপে সরকার সাড়া দেবে না। তাই এই মুহূর্তে কোনো প্রকার আল্টিমেটামের পথে না গিয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন তারা। তবে আন্দোলনের গতিপথ ও রোডম্যাপ তৈরিতে বিশেষ পরামর্শ দেবেন নব্বইয়ের ওইসব ছাত্রনেতা। মূলত তাদের পরামর্শকে সামনে রেখে কর্মসূচি নির্ধারণ করবেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সব দলের ছাত্রসংগঠনকে একই প্ল্যাটফর্মে আনার ওই প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের আহ্বায়ক ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান এবং যুগ্ম আহ্বায়ক ও তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব। তাদের সঙ্গে থাকছেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, ডাকসুর তৎকালীন জিএস খায়রুল কবির খোকন, এজিএস নাজিমউদ্দিন আলম, ছাত্রদলের তখনকার নেতা আসাদুজ্জামান রিপন, ফজলুল হক মিলন, শিরিন সুলতানা, শহিদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, গণতান্ত্রিক ছাত্রলীগের নেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, জাগপা ছাত্রলীগের নেতা খন্দকার লুৎফর রহমান, আসাদুর রহমান খান, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল প্রমুখ।
নিজেকে উদ্ধৃত করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ‘৯০-এর আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এক নেতা জানিয়েছেন, তারা মূলত ‘৯০-এর আদলেই আন্দোলন করতে চান। সেজন্য ছাত্র-আন্দোলনকে সামনের সারিতে রাখার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এজন্য সব দলের ছাত্রসংগঠনকে এককাতারে আনার প্রচেষ্টা চালানো হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ছাত্রশিবিরকে এই ঐক্যের আওতায় আনা হবে কিনা, সে সম্পর্কে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
ওই নেতা বলেন, সরকারকে হটাতে নয়, বিএনপি তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এবার আন্দোলনে নামবে। ‘৯০-এ ছাত্রদলের জালাল ও বাবলু যেভাবে নিজেরা মৃত্যুকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে স্বৈরাচার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিলেন সেভাবেই আন্দোলন হবে।
জানতে চাইলে কনভেনশনের সমন্বয়ক ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান বলেন, দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নেই। মানবতা ও মানবাধিকার এখন পদদলিত। তৎকালীন সামরিক স্বৈরাচারের চাইতেও নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদী এক শাসন অক্টোপাসের মতোই গোটা জাতিকে গ্রাস করেছে। এটা আর চলতে দেয়া যায় না।
তিনি বলেন, এই কারণে আমরা আর বসে থাকতে পারি না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি_ ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের উদ্যোগে তৎকালীন ও বর্তমান ছাত্র-নেতাদের সমন্বয়ে ঢাকায় একটি ছাত্র কনভেনশন করব। ঠিক যেমনটি আমরা করেছিলাম ১৯৯০ সালের ১ অক্টোবর। যার ফলে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল।
বিএনপির এ কৌশলের পাশাপাশি ১৯৯৬ সালে সরকারি কর্মকর্তারা যেভাবে জনতার মঞ্চ তৈরি করেছিলেন তেমন না হলেও সরকারবিরোধী আন্দোলনে সিভিল প্রশাসনসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের ভবিষ্যৎ সরকারবিরোধী আন্দোলনে পাশে চায় বিএনপি। এ নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বর্তমান ও সাবেক অর্ধশতাধিক আমলা সাক্ষাৎ করেন।
যদিও ওই বৈঠকের পর সরকার নড়েচড়ে বসেছে। ইতিমধ্যে ওইসব আমলাদের চিহ্নিত এবং বাধ্যতামূলক অবসরের মতো শাস্তির ঘটনাও ঘটেছে। তবুও বৈষম্যের শিকার আমলারা বিএনপির আন্দোলনে পাশে থাকবে বলে প্রত্যাশা করছে দলটি। একইভাবে গত দুই মাস ধরে বিএনপিপ্রধান চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ অন্য পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আওয়ামী লীগ বুদ্ধিজীবী দিবস, স্বাধীনতা দিবস মানে না। জনগণের ভোটাধিকার দিতে জানে না। এর স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হয়েছে। তাই ‘৭১ ও ‘৯০-এর মতো আবারো আন্দোলন করে বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে হবে। আর তা হবে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বলেও তিনি জানান।
তিনি বলেন, চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য দলের মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। আগামী জানুয়ারিতে তা বাস্তবে রূপ নেবে। আর আন্দোলনে বাধা দিলে তার দায়ভার স্বৈরাচারী এ সরকারকেই নিতে হবে।
এদিকে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে বিএনপি সারাদেশ থেকে দলের সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করেছে। ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই কার্যক্রম চলবে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। জানা যায়, দলের সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম প্রতি তিন বছর পর পর হওয়ার কথা থাকলে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কিছুটা দেরিতে শুরু হয়েছে। তবে এবার সারাদেশের প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে কমপক্ষে এক হাজার সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিএনপি। সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম সুচারুভাবে সম্পাদন করতে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে কেন্দ্র থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ঢাকার সাংগঠনিক অবস্থা দ্রুত আন্দোলন উপযোগী করার জন্য কয়েকজন নেতাকে মনিটরিং করতে বলেছেন বেগম খালেদা জিয়া। আন্দোলনে মূল টার্গেট থাকবে ঢাকা অচল করে দেয়া। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনে ঢাকা নিষ্ক্রিয় থাকায় সফলতা আসেনি বলে মনে করেন দলের হাইকমান্ড। এ কারণে বড় মাত্রায় নজর দেয়া হচ্ছে ঢাকার দিকে।
ডিসেম্বর মাসকে কেন্দ্র করে বিএনপি আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নেবে জানিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ওই আন্দোলন বিভিন্ন রকমের হতে পারে। দল আপাতত জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে। সরকার যদি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অবহেলা করে তাহলে তারা শক্ত আন্দোলনের দিকে যাবে। সরকার যদি সেই অহিংস আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করে তাহলে জনগণই মারমুখী হবে। –
আশিকুর রহমান চৌধুরী স্বদেশ নিউজ২৪.com