আদালতের প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের অনাস্থা; ন্যায়বিচার পাবেন না জানিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি রাখার আরজি; এ সংক্রান্ত আবেদনের ওপর দিনভর শুনানি; শেষ বেলায় হইচই; দুইপক্ষের আইনজীবীদের তুমুল বাগি¦তণ্ডার মধ্যে পুলিশের ব্যারিকেড এবং এর মধ্যেই আবার ৩-৪ মিনিটের সাক্ষ্যগ্রহণ। গতকাল বুধবার এভাবেই কাটে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের চতুর্থ দিন।
সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায় আগামী ২৪ ডিসেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। এ দিকে আদালতে হইচইয়ের কারণে সাক্ষ্যে মামলার বাদি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক হারুনুর রশীদ কি বলেছেন, তা এ দিনও কেউ স্পষ্ট শুনতে পাননি। সাক্ষ্য দেয়া শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এজাহার থেকে কিছু অংশ পড়েছি’। কী পড়েছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘বলা নিষেধ আছে’।
এর আগে এই মামলায় আদালত পরিবর্তন প্রশ্নে আবেদন উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে জানিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি রাখতে আরজি জানান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী। কয়েক দফা শুনানিতে তিনি বিচারককে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নাই। আমরা আপনার কাছে ন্যায়বিচার পাবো না। সাবেক এই অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, আমরা আপনার প্রতি অনাস্থা জানিয়েছি। তাই এ মামলায় আপনার সাক্ষ্য নেয়ার আর কোনো এখতিয়ার নাই। সুপ্রিম কোর্টে বলেছি; এখানেও বলতে আপত্তি নেই।
তিনি আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার প্রতি আস্থা নাইÑ এটা বলার পরও আপনি বিচারকার্যক্রম চালাতে পারেন না। আপনি আমাদের আবেদন খারিজ করেছেন। আমরা হাইকোর্টে গিয়েছি। হাইকোর্ট বিষয়টি শুনছেন। আপনি হাইকোর্টকে সুপারসিড করতে পারেন না। আমরা বারবার বলছিÑ আমরা ন্যায়বিচার পাবো না। আপনি বলেছেনÑ আমাকে বিচার করতে বসানো হয়েছে। কিন্তু কোনো জুডিশিয়াল অফিসার বিচার ছাড়া অন্য কোনো কাজ করতে বসেন সেটা আমাদের জানা নাই।
খালেদা জিয়ার পক্ষে এ দিনে আরো শুনানি করেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মহসিন মিয়া ও সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোসলেহ উদ্দিন জসীম, অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার প্রমুখ। তাদের সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার এ কে এম এহসানুর রহমান। দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান।
গতকাল দুপুর ১২টা ১ মিনিটে বিচারক আদালতে বসলে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে চারটি আবেদন দাখিল করেন তার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া। দু’টি আবেদন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতির জন্য এবং অন্য দু’টি মামলার কার্যক্রম মুলতবি রাখার জন্য। এরপর এসব আবেদনের ওপর শুনানি হয়।
শুনানিতে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন বলেন, সময় চেয়ে আমাদের একটি আবেদন আপনি খারিজ করে আদেশ দিয়েছেন। সেই আদেশে আমরা ুব্ধ হয়েছি। তাই সেটি নিয়ে হাইকোর্টে গিয়েছি। সেখানে দুদককে পক্ষ করেছি। সর্বশেষ কর্মদিবসে উচ্চ আদালত আমাদের শুনেছেন। হাইকোর্ট উভয়পক্ষকে না শুনে আদেশ দিতে পারেন না; তাই অবকাশের ছুটির পর দুদককে শুনবেন এবং আদেশ দেবেন। যেহেতু এই মামলার বিষয়ে আবেদনের ওপর উচ্চ আদালতে শুনানি হচ্ছে, তাই এখানে মামলার কার্যক্রম মুলতবি রাখা হোক।
জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, উচ্চ আদালত কোনো স্থগিতাদেশ দেননি। দিলে আমরাই আপনাকে (বিচারক) জানাব। এটা একটা বিশেষ মামলা। আইনের অনুবিধিতে আছে, আপনি মামলার কার্যক্রম মুলতবি করতে বাধ্য নন। এ পর্যায়ে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, যে অনুবিধিতে আপনি মামলার কার্যক্রম চালাচ্ছেন তা এখন মৃত। কারণ আইনটা পরিবর্তন হয়ে গেছে।
উভয়পক্ষকে শুনে আদালত বলেন, বেগম জিয়ার অনুপস্থিতির আবেদন বিবেচনা করছি। তবে আগামী তারিখে অবশ্যই তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। মামলা পরিচালনায় যেহেতু উচ্চ আদালতের কোনো স্থগিতাদেশ নেই; তাই মুলতবির আবেদন নাকচ করছি। সাক্ষ্য হবে।
এ পর্যায়ে আদেশ পুনর্বিবেচনা করতে বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে আবার দরখাস্ত দেয়া হয়। এর ওপর বেলা ১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত শুনানি হয়। এরপর আদালত পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেন ও দুপুরের বিরতি দেন।
বেলা ৩টা ৫ মিনিটে পুনরায় আদালত বসলে আবার পুনর্বিবেচনা করতে আবেদন জমা দেয়া হয়। বেলা ৪টা ২০ মিনিট পর্যন্ত শুনানি হয়। এ সময় মনিরুল ইসলাম নামে এক আসামির পক্ষে দাঁড়িয়ে একজন আইনজীবী বলেন, তার (মনিরুল) পিতা কয়েক দিন আগে ইন্তেকাল করেছেন। পিতাকে দাফন করতে তিনি গ্রামে গেছেন। এই আসামি মামলার কোনো তারিখেই অনুপস্থিত থাকেননি। তাই তার উপস্থিতিতে সাক্ষ্য নেয়া হোক। সে জন্য কার্যক্রম মুলতবি রাখা হোক। তিনি আরো বলেন, আইন সবার জন্য সমান। দেশে লাখ লাখ মামলা আছে। এই মামলাও অন্যসব মামলার মতো চলবে। এর অন্যথা হলে মনে হবে এটি বিশেষভাবে নেয়া হচ্ছে। আজ অনাস্থার বিষয় আসছে। আপনি একতরফাভাবে চার্জ গঠন করে সাক্ষীর তারিখ দিয়েছেন।
অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, আদালতের অসহায় অবস্থা আমাদের আনন্দ দেয় না। আমরা আদালতকে স্বাধীন দেখতে চাই। এক লাইন সাক্ষ্য লিখলে আপনার মনে হতে পারে দেশের জন্য বিরাট কিছু করে ফেলেছেনÑ এটা একজন বিচারককে মানায় না। আমরা আপনার বিপক্ষে না, অংশীদার হয়ে কথা বলছি। এরপর আদালতে বেগম জিয়ার পক্ষে আরো কয়েকজন বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সবাইকে শুনে আদালত বেগম জিয়ার আবেদন খারিজ করে দেন ও সাক্ষ্য গ্রহণের নির্দেশ দেন। এরপর শুরু হয় হইচই। এর মধ্যেই কয়েক মিনিট চলে সাক্ষ্যগ্রহণ।
গতকাল আদালতে বেগম জিয়ার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেনÑ ড. আরিফা জেসমিন নাহিন, মোহাম্মদ আলী, মির্জা আল মাহমুদ, আইয়ুব আলী আশরাফী, ছিদ্দিক উল্যাহ মিয়া, তাহেরুল ইসলাম তৌহিদ, আনিছুর রহমান খান, এম মাসুদ রানা প্রমুখ।
-আশিকুর রহমান চৌধুরী স্বদেশ নিউজ২৪.com