পেশোয়ারে আর্মি পাবলিক স্কুলে শিশুদের ওপর বর্বর জঙ্গি হত্যাযজ্ঞে শোকে স্তব্ধ পাকিস্তান। নিহতদের পরিবারে এখনও কেবলই কান্না আর আহাজারি। শোকে পাথর স্বজনরা বুক চাপড়ে প্রিয়মুখগুলোকে দিয়েছেন চিরবিদায়। আর জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা, কোরআন খানি, বিশেষ মোনাজাত, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, নীরবতা পালন, প্রতিবাদ- ইত্যাদি কর্মসূচিতে পুরো জাতি স্মরণ করছে নিহতদের।
পেশোয়ারে গভর্নর হাউসে বুধবার সব দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। বৈঠকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ওপর ছয় বছর ধরে চলে আসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ঘোষণা দেন তিনি। সভায় সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। প্রয়োজনীয় সুপারিশ করে সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে তাদের।খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের তালেবান অধ্যুষিত দুর্গম অঞ্চলে ও দেশটির সীমান্তবর্তী কয়েকটি স্থানে বুধবার বিমান হামলা চালিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। ওই হামলায় বিস্তারিত তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে সেনাপ্রধান জেনারেল রাহেল শরিফ এক বার্তায় দাবি করেছেন, খাইবার অঞ্চলে ‘ম্যাসিভ এয়ার স্ট্রাইক’ চালিয়েছেন তারা।মঙ্গলবারের হামলার পর তেহরিক-ই-তালেবান দায় শিকার করে জানিয়েছিল তাদের পরিবারের ওপর আক্রমণের ‘জবাব’ দিতেই স্কুলে ওই হামলা চালানো হয়। আর বুধবার সেনাবাহিনীর বিমান হামলার জবাব তারা দিয়েছে আরেকটি বালিকা মহাবিদ্যালয়ে বোমা হামলা চালিয়ে। খাইবারের ডেরা ইসমাইল খান শহরে গার্লস ডিগ্রি কলেজে বিকালে দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। তবে এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।পাকিস্তানের স্কুল শিক্ষার্থীদের শোকে সমব্যথী সারা বিশ্বই। এর মধ্যে বুধবার ভারতে স্কুলে স্কুলে নীরবতা পালন করা হয়। জ্বালানো হয় মোমবাতি ও মঙ্গলপ্রদীপ, করা হয় বিশেষ প্রার্থনা। পাকিস্তানের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তুরস্কও বুধবার এক দিনের জাতীয় শোক পালন করে। এর আগে এর ঘোষণা দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভোগলু। আর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নওয়াজ শরিফকে ফোন করে জানিয়েছেন সমবেদনা।সেনাবাহিনী পরিচালিত ওই স্কুলে মঙ্গলবারের জঙ্গি হামলায় ১৪১ জন নিহত হয়, যাদের ১৩২ জনই শিক্ষার্থী। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বয়স ১০ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। নিহত অন্যরা শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এছাড়া ওই হামলায় আরও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন, যার বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। আহতদের অনেকের অবস্থা বুধবারও ছিল আশংকাজনক। ডন, এনডিটিভি, এএফপি, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান ও রয়টার্স।পাকিস্তানে বুধবার থেকে শুরু হয়েছে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক। এর অংশ হিসেবে সব প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এদিন। বিদেশে পাকিস্তানি দূতাবাসেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। খোলা হয় শোকবই।পাকিস্তানের সব স্কুলই বন্ধ ছিল বুধবার। তারপরও স্কুলগুলো ছিল শিক্ষার্থীতে ঠাসা। এদিন স্কুলে ¯ু‹লে করা হয় বিশেষ মোনাজাত ও কোরআনখানি। দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জ্বালানো হয় মোমবাতি। কোথাও কোথাও ফুল ছিটিয়ে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয় নিহতদের। বিভিন্ন শহরে রাতেও মোম জ্বালিয়ে সমবেত হয়ে শোক প্রকাশ করে সাধারণ মানুষ। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রত্যয় জানান তারা। বর্বর এ হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও বুধবার শোক আর নিন্দার ঝড় বয়ে গেছে।তবে সবচেয়ে হৃদয় বিদারক দৃশ্য ছিল নিহতদের পরিবারে। স্বপ্ন, সন্তান আর স্বজনের এমন মৃত্যু মানতে পারছিলেন না তারা।ফুলে ছাওয়া কফিন কাঁধে ছুটেছেন পথে, কবরস্থানে। গগণবিদারী চিৎকার আর আহাজারির মধ্যেই প্রিয় মুখগুলোকে করেছেন দাফন। সে সময় প্রতিবেশীরা ধরে রাখতে পারেননি চোখের বাঁধ। সহপাঠী শিক্ষার্থীদের চোখমুখে ছিল কান্না আর আতংক।নিহতদের একজন ১০ বছর বয়সী গুল শের। তার চাচা সাজিদ খান জানান, তার ভাইপোর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল। সব ধুয়ে মুছে গেল। চোখ মুছতে মুছতেই তিনি বলেন, আমরা এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পারব না, প্রতিশোধের জন্য শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করতে পারব। প্রায় আট ঘণ্টার সেনা অভিযানে নয় জঙ্গির মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে মঙ্গলবার বিকালে সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটে। তবে বুধবারও পেশোয়ারের হাসপাতালে হাসপাতালে আহত সন্তানের জন্য অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন প্রহর কেটেছে। আর পুরো পাকিস্তান দিন-রাত কাটিয়েছে অনিশ্চিত অন্ধকারের আশংকায়। –
আশিকুর রহমান চৌধুরী স্বদেশ নিউজ২৪.com