কামরুল ইসলাম হৃদয়,চট্টগ্রাম ব্যুরো:নাস্তিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিসহ ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলনে নামা অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের মধ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নেতৃত্বে টানাপড়েন, আমিরপুত্রের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অপচেষ্টাসহ নানা অভিযোগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন সংগঠনটির নীতিনির্ধারকরা।এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সংগঠনের সর্বস্তরে- যা আলোচিত সংগঠনটির কেবল ভাঙন ত্বরান্বিত করছে। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা জানান, দ্রুত এই সংকট উত্তরণ করা না গেলে ভাঙনের মুখে পড়তে পারে দলটি।ইতোমধ্যে আলোচিত অপর এক নেতার নেতৃত্বে সংগঠনটি বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে- এমন বক্তব্য হেফাজতের অভ্যন্তরে ঘুরপাক খাচ্ছে।সংগঠনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে জানান, পিতার শারীরিক দুর্বলতার অজুহাতে সংগঠনের কর্তৃত্ব কুক্ষিগত করতে চান আমিরপুত্র আনাস। এ নিয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে চলছে পিতাপুত্রের টানাপড়েন।সম্প্রতি পদচ্যুত মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুতে এ সঙ্কট আরও প্রকট হয়েছে। এ ইস্যুতে হেফাজতের রহস্যময় আচরণে ক্ষুব্ধ হয় সর্বস্তরের নেতাকর্মী। ব্যাপক সমালোনার মুখেও নীরবতা ভাঙেনি তাদের।এ পর্যায়ে নেতৃত্বের পরিবর্তন চাইছেন সংগঠনের বিভিন্ন সারির নেতাকর্মীরা। মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতকে গতিশীল করতে চান অনেকেই। এ নিয়ে হেফাজতের বড় একটি অংশ মাঠে নেমেছে।এদিকে একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে হাটহাজারীর ঐতিহাসিক দারুল উলুম মাদরাসায়। এ প্রতিষ্ঠানের তহবিলসহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন আনাস। আহমদ শফীর অবর্তমানে ওই মাদরাসার মহাপরিচালকের দায়িত্বটিও পেতে মরিয়া তিনি- এমন তথ্য সংশ্লিষ্টদের।এ ব্যাপারে হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, ‘আনাস দারুল উলুম মাদরাসার দায়িত্ব নিতে চান বলে শুনেছি, তবে হেফাজতের আমির হতে চান কিনা আমার জানা নেই। অবশ্য তিনি চাইলেই এ সংগঠনের আমির হতে পারবেন না। কারণ, সেই দক্ষতা গ্রহণযোগ্যতা এখনও হয়নি তার।’হেফাজতের নিষ্ক্রিয়তার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে অস্ত্রতান্ত্রিক রাজনীতি চলছে। আমাদের অস্ত্র নেই। অস্ত্রের ভাষায় আমরা কথা বলতে পারি না।’ তবে শাপলা ট্র্যাজেডির পর সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে আর কোনো বৈঠক না হওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বেশ কয়েকজন হেফাজত নেতা জানান, গত বছর ২৭ ডিসেম্বর উচ্চপদস্থ এক সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর থেকেই হেফাজত আমিরের আচরণে পরিবর্তন শুরু হয়। সেই থেকে ১৩ দফা দাবি নিয়ে কোন বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি তাকে।এছাড়া চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে শানে রেসালাত সম্মেলনের শেষ দিন মঞ্চে হেফাজত বিরোধী হিসেবে পরিচিত বেশ কয়েকজন আলেমের উপস্থিতিও অনেক রহস্যের জন্ম দিয়েছে। এজন্য সংঠনের ভেতরেই অনেক কানাঘুষা চলেছে।অনেকের মতে বার্ধক্যের কারণে হেফাজত আমির সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা অক্ষম হয়ে পুত্রের প্রতি অত্যধিক স্নেহ ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ার সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছেন আমিরপুত্র আনাস।ঢাকা মহানগরী ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতা জানান, ১৩ দফা আন্দোলনের পক্ষ ও বিপক্ষ বিভিন্ন সূত্র থেকে আর্থিক সুবিধার ধারা ঠিক রাখার জন্যই ৫ মে শাপলা চত্বরের ট্র্যাজেডির পর ঘন ঘন কর্মসূচি দেয়া ও প্রত্যাহারের খেলা চালু রাখা হয়েছিল।ঢাকা মহানগরীর হেফাজতের এক নেতা বলেন, গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা মহাসমাবেশ কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর জরুরি আলোচনার জন্য মহানগরীর প্রায় ৩০ নেতা আমিরের সঙ্গে আলোচনার জন্য গেলে তখন আনাস তাদের সঙ্গে চরম দুর্বব্যহার করেন।সারাদিন তাদের অভুক্ত রেখে আমিরের সঙ্গে কোন সাক্ষাৎ করতে দেননি। সর্বশেষ আছরের নামাজের পর সাংগঠনিক কোনো কথা ছাড়া শুধু সালাম বিনিময় ও দোয়া নেয়ার শর্তে পাঁচ মিনিটের জন্য সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়।তখন থেকে বেশির ভাগ নেতাই হাটহাজারী মাদরাসামুখী হন না। এমনকি, সংগঠনটির সিনিয়র নায়েবে আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী ২৩ মে’র ব্যর্থ শূরা বৈঠক ছাড়া আহমদ শফীর সঙ্গে আর কোন বৈঠকে শরিক হননি।বিষয়টি স্বীকার করে মহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, অনেক দিন হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের কোন বৈঠক হচ্ছে না। আমরাও যাচ্ছি না। তবে এরই মধ্যে যে কয়টা বৈঠক হয়েছে, তাতে আমিরপুত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন এমন কয়েকজন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোন নেতাকেই দেখা যায়নি।বিশেষ করে ২৩ মে শূরা বৈঠক চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই কার্যত হেফাজত আমির এক ঘরে হয়ে পড়েছেন। এতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোনো অঞ্চলের সক্রিয় নেতাদের কেউই এখন কেন্দ্রীয় কার্যালয়মুখী হন না।এর মধ্যে পটিয়া মাদরাসা, দারুল মাআরিফ মাদরাসা, ষোলশহর মাদরাসা, বাবুনগর মাদরাসা, মেখল মাদরাসা, জিরি মাদরাসাসহ চট্টগ্রামের বড় বড় কওমি মাদরাসাসমূহের পরিচালকরা অনেকটাই তাকে এড়িয়ে চলেন।এসব মাদরাসার সঙ্গে সম্পৃক্তদের অনেকেই হতাশা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাসমূহের প্রাণকেন্দ্র হাটহাজারী মাদরাসা বর্তমানে তার গৌরবময় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আনাসের প্ররোচনায় হাটহাজারী মাদরাসার অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষককে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।আর যেসব প্রভাবশালী শিক্ষক মারা গেছেন, সে সব শূন্যপদে গুরুত্বপূর্ণ কাউকে নিয়োগ না দিয়ে নিম্নস্তরের শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ক্ষমতা সুসংহত করে যাচ্ছেন আনাস।সংশ্লিষ্টরা জানান, মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর মতো দেশবরেণ্য আলেমকে শিক্ষকতা ছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কোন পদে রাখা হয়নি। এ নিয়ে হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক ও শুভাকাঙক্ষীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।ঢাকার এক হেফাজত নেতা জানান, শাপলা চত্বরের ট্র্যাজেডির পর ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আহমদ শফিপুত্র আনাস, পিএস শফিকে নিয়ে সৌদি আরব সফরকালে সেখানে তাকে এক নজর দেখার জন্য এবং তার কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার জন্য প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল।কিন্তু এবার হজের সফরে মাসজুড়ে আহমদ শফি অনেকটা নিঃসঙ্গ সময় কাটিয়েছেন। আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে প্রবাসীদের কানাঘুষা ও অসন্তোষ লক্ষ্য করে আমিরপুত্র আনাস তার চলাফেরা খুব সীমিত রেখেছিলেন সৌদি আরবে।হেফাজতের এক নেতা জানান, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দেশে ফেরার পর গ্রেপ্তারের দাবি এবং ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ ও হরতাল কর্মসূচি দেয় হেফাজত।কিন্তু তার গ্রেপ্তার হওয়ার খবর শোনার পর তড়িঘড়ি বিক্ষোভ স্থগিত ও হরতাল প্রত্যাহারে অনেকেই বিস্মিত হন।নেতাদের অনেকেই জানান, ধর্ম অবমাননার আইন পাশের গুরুত্বপূর্ণ দাবি অপূরণ এবং লতিফকে গ্রেপ্তারের নাটকের সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করায় কর্মীরা চরম হতাশ হয়ে পড়েন।এমনকি কোনো কোনো মিডিয়ায় সরকারকে আমিরের ধন্যবাদ জানানোর খবরও প্রকাশিত হয়। এসব নিয়ে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়ায় ভাঙনের মুখে পড়েছে সংগঠনটি।