ইন্টারনেট মূলত একটি বিশাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক। আর এখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানে সমগ্র বিশ্ব থেকেই আলাদা হয়ে যাওয়া। কিন্তু কিউবার তরুণদের জন্য এটি কোন ব্যাপারই না। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় কিউবার এই তরুণরা নিজেদের মধ্যে তৈরি করে নিয়েছে এক বিশাল ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক। বিশাল এই নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে সমগ্র হাভান জুড়ে। গোপন এই নেটওয়ার্কের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে চ্যাট করা, গেম খেলা এবং বিভিন্ন কন্টেন্ট ডাউনলোড করার কাজটি খুব সহজেই করতে পারছেন।
কিউবায় বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ নিষিদ্ধ। তবে হাতে গোনা কিছু কিউবান এই সুবিধা পাচ্ছেন। অন্যদিকে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্যও পরিশোধ করতে হয় চড়া মূল্য। মাত্র এক ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য সেখানে এক মাসের বেতনের প্রায় চার ভাগের একভাগ খরচ হয়ে যায়। এর ফলে দেশটির অধিকাংশ মানুষ এখনও অফলাইনে। আর এসব নিয়ে অন্য দেশে থাকা বন্ধুবান্ধবদের তাদের আক্ষেপের কথাও জানান তাঁরা।
আর এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছে দেশটির সাহসী তরুণ সম্প্রদায়। নিজেদের মধ্য থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তাঁরা বাসার ছাদে, রাস্তায় এবং আরও কিছু জায়গায় বসিয়েছেন সস্তা এবং ছোট আকারের গোপন ওয়াইফাই অ্যান্টেনা এবং ইথারনেট ক্যাবল। প্রায় ৯,০০০ সদস্যের এই কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাইরের কোন সংস্থার অর্থ কিংবা কারিগরি সহায়তা ছাড়াই শুধুমাত্র নিজেদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তাঁরা এটি তৈরি করেছেন।
এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তাঁরা খেলেছেন বিভিন্ন গেম যার মধ্যে রয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ারক্র্যাফট’, ‘কল অফ ডিউটি’ প্রভৃতি। প্রতি মুহূর্তেই তাদের এই নেটওয়ার্কে শ’খানেক সদস্যকে পাওয়া যাবে। এর পাশাপাশি তাঁরা নিজেদের মধ্যে চ্যাট করছেন। ইন্টারনেটের মতই তাদের গোপন ইন্টারনেট ব্যবহার করে আয়োজন করছেন বিভিন্ন ইভেন্টের।
তাদের এই নেটওয়ার্কের নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্ট্রিটনেট’ যার সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে তাঁরা একে এস নেট বলে থাকেন। এই নেটওয়ার্ক নিরমানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সেখানকার একজন তড়িৎপ্রকৌশলী রাফায়েল অ্যান্টোনিও। ২২ বছর বয়সী এই তরুণ জানান, “আমাদের ইন্টারনেট সত্যিই খুব দরকার কারণ সেখানে রয়েছে অসংখ্য তথ্যের সমাহার। তবে আমাদের এই ক্ষুদ্র ইন্টারনেট পেয়ে আমরা সন্তুষ্ট কারণ অন্তত এখন আমরা অনেকের সাথে সংযুক্ত থাকতে পারছি, তাদের সাথে কথা বলা কিংবা ফাইল শেয়ার করার কাজটিও সম্ভব হচ্ছে।”
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট সুবিধা বঞ্চিত দেশগুলোর মধ্যে কিউবা অন্যতম। দীর্ঘ একটি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৈরিতা চলে আসছিল দেশটির। আর এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকা ইন্টারনেট জগতের খুব বেশি সুফল দেশটিতে পৌঁছেনি। কিউবার বিভিন্ন সরকারি সংস্থা জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বাণিজ্যিক চুক্তির ফলে সেখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। তাই প্রয়োজন হলে বিভিন্ন সরঞ্জাম অন্য দেশ থেকে কিনে নিতে হয়।
তবে আশার কথা হল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিউবার সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রও তাই দেশটিতে ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর জোর দিচ্ছে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিভিন্ন টেলিকম সরঞ্জাম কিনতে উৎসাহিত করেছে। তবে কিউবার সরকার মনে করছে, কিউবায় চলতে থাকা দীর্ঘদিনের এই সিস্টেম সহসাই পরিবর্তন হয়ে যাবে, এমন কোন সম্ভাবনা তাদের চোখে পড়ছে না।
তবে দেশটিতে ইন্টারনেট ব্যবস্থার এই দুর্দশার জন্য পর্যবেক্ষক মহল কিংবা কিউবানরা দেশটির সরকারকেই দোষারোপ করে থাকে। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, সরকার ইন্টারনেট এবং ফোনকলের উপর বাড়তি চার্জ আরোপ করে সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করে যা দিয়ে বিভিন্ন সংস্থার খরচ মেটানো যায়। মূলত এ কারণেই ইন্টারনেট ব্যবস্থা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের খুব একটা সদিচ্ছা নেই।
কিউবায় ওয়াইফাই ইকুইপমেন্ট ব্যবহার নিষিদ্ধ। কেবলমাত্র সরকারের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে এটি ব্যবহার করা যায়। আর তাই তরুণদের এই স্ট্রিট নেটও সরকারের দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে অবৈধ। আশাবাদি রাফায়েল অ্যান্টোনিও মনে করেন, সরকার আইনের পরিবর্তন আনবে এবং স্ট্রিট নেটের মত এই ধরণের ক্ষুদ্র নেটওয়ার্ককেও বৈধতা দেবে। তিনি জানান, আনুষ্ঠানিক কোন অনুমতি না থাকলেও সরকারি সংস্থার কাছ থেকে তাঁরা এক ধরণের মউখিক সম্মতি পেয়েছেন। তাদের নিজেদের মধ্যে রয়েছেন একদল স্বেচ্ছাসেবী যারা নিয়মিত এই নেটওয়ার্কের মধ্যে নজরদারি করেন এবং নিশ্চিত করেন যেন এখানে কেউ পর্ণ কন্টেন্ট শেয়ার না করে, রাজনৈতিক আলোচনা না করে কিংবা ‘বাস্তব’ ইন্টারনেটের সাথে এই নেটওয়ার্ক যুক্ত করার চেষ্টা না করে। আর এসব নিশ্চয়তার ভিত্তিতে সরকার তাদের সাথে কোন ঝামেলায় জড়ায় না।
রাফায়েল জানান, “আমরা অ্যানোনিমাস নই। কারণ দেশের মানুষের জানতে হবে যে এই ধরণের নেটওয়ার্ক এখানে রয়েছে। তাদের এই দেশকে রক্ষা করতে হবে এবং তাঁরা জানে যে ৯,০০০ তরুণকে যেকোনো কাজে লাগানো সম্ভব।” তিনি আরও জানান, “আমরা কারও সাথে ঝামেলায় জড়াই না। আমরা কেবল এখানে গেম খেলি এবং নিজেদের মধ্যে দারুণ কিছু আইডিয়া শেয়ার করি। আমরা সরকারকে কোন কিছুতে প্রভাবিত করার চেষ্টা করি না। আমরা আমাদের কাজটিই করি আর তাই সরকার আমাদের সাথে কোন ঝামেলা করতে আসে না।”
কেউ এই নিয়ম ভাঙ্গলে তাঁকে নেটওয়ার্ক থেকে ব্যান করে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন একদিন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকে। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে তাদের ফাইল ট্রান্সফারের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। তবে পর্নোগ্রাফি আদান-প্রদান করলে তাদের একেবারে নিষিদ্ধ করা হয়।
“ব্যবহারকারীরাও এটি সঠিক ব্যবহারে সবসময় সচেষ্ট থাকে। কারণ আমাদের হাতে এই একটি মাত্র উপায়ই রয়েছ। তবে আমি এবং অন্য নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনরা নিয়মিতই এখানে নজর রাখছি যাতে আমাদের এই নেটওয়ার্কের ব্যবহার আমাদের প্রয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।”, জানান রাফায়েল।
তবে এটি ব্যবহার করতে গিয়ে অনেকেই আবার ঝামেলার শিকার হয়েছেন। এমনই একজন হাম্বারটো ভিনাস। ২৫ বছরের এই তরুণ জানান, “আমরা ১০ জন মিলে এস নেটের একটি নোড ব্যবহার করতাম। আর এজন্য প্রতিবেশীদের ছাদের উপর দিয়ে ইথারনেট ক্যাবল টানতে হয়েছিল। বেশ কয়েক মাস ব্যবহারের পর একজন প্রতিবেশী ইথারনেট ক্যাবলটি সরিয়ে ফেলতে বলায় আমরা সেটি সরিয়ে ফেলি। আর ের ফলে অনেকেই নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই।” তিনি জানান, “এস নেটকে আমি এখনও মিস করি। এখানে আমি বিভিন্ন ফুটবল ম্যাচের আপডেট পেতাম। বাড়িতে বসেই অনেক কিছু করা যেত এর মাধ্যমে”
মূলত ২০০১ সালের দিকে এটি চালু হয়। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর হাতে গোনা কিছু ব্যবহারকারী নিয়ে এটি চলেছিল। তবে গত ৫ বছরে এর সদস্য সংখ্যা ৯,০০০ ছাড়িয়ে যায়। প্রতিদিন প্রায় ২,০০০ মানুষ এটি ব্যবহার করে।
অনেকেই বিভিন্ন টিভি শো এবং মুভির জন্য এস নেট ব্যবহার করে। এছাড়া এই নেটওয়ার্কে উইকিপিডিয়ার একটি কপি সংরক্ষিত আছে। যদিও সর্বশেষ সংস্করণের সব তথ্য এতে থাকে না, তবে যেসকল ব্যবহারকারীর রিয়েল ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে, তাঁরা নিয়মিত এটি আপডেট করে থাকেন। এছাড়া এখানে রয়েছে একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও যার মাধ্যমে অনেকটা ফেসবুকের মতই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করা যায়।