আরিফ উদ্দিন, গাইবান্ধা থেকেঃ গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চন্ডিপুর, পাঁচপীর, কালিরখামারসহ কয়েকটি গ্রামে যাত্রীবাহি বাসে পেট্রোল বোমা হামলায় নিহতদের পরিবার-পরিজনের কান্না যেন আর থামছেই না। তাদের মৃত্যুর ৯ দিন অতিবাহিত হয়েছে। অথচ স্বজন এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে পরিবারগুলো এখন দিশেহারা। এখন কি করবে তারা। আর কিভাবেই বা কাটবে তাদের আগামী দিনের জীবন জীবিকা। এসব কারণেই যেন এখনও তারা এই অক্ষম কান্না দিয়েই কষ্টকে আড়াল করার চেষ্টা চালা”েছ। অবরোধ-হরতালের নামে সহিংসতা এবং নাশকতায় ঢাকায় কাজের জন্য যাওয়ার পথে গাইবান্ধার তুলসীঘাটে শ্রমজীবি অতিসাধারণ মানুষগুলোকে যেভাবে পেট্রোল বোমা হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে তা যেন তারা কিছুতেই ভুলে যেতে পারছে না। নিহতদের স্বজনদের এতো কষ্টেও তাই একটাই দাবি ওরা ক্ষতিপূরণ চায় না, পেট্রোল বোমা হামলাকারিদের বিচার চায় আর চায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আর একটি দাবি তাদের সন্তানদের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা।
সরেজমিনে ওইসব এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এমন কর“ণ চিত্র, যা যে কাউকেই বেদনা বিধুর করে তুলবে। সংসার চালাতে গ্রামের দাদন ব্যবসায়িদের কাছ থেকে বাধ্য হয়ে পথ খরচ বাবদ ৩০০ টাকা ঋণ নিয়ে ঢাকা যা”িছলেন সৈয়দ আলী। কিš‘ তিনি তা শোধ করতে পারেননি। ই”ছা ছিল ঢাকায় গিয়ে কাজ করে টাকা শোধ দেবেন। আর পরিবারের দুবেলার দুমুঠো খাবার যোগার করতে সে বাড়িতেও সংসার খরচের টাকা পাঠাবে। কিš‘ সে ই”ছা তার বাস্তবায়িত হয়নি। গত ৬ ফেব্র“য়ারি তুলসীঘাটের বুড়িরঘর এলাকায় অবরোধকারিদের পেট্রোল বোমায় আগুনে পুড়ে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অবশেষে পরিবারের শেষ সম্বলটুকু তুলে দিতে হয়েছে দাদন ব্যবসায়িদের হাতে তার ঋণের টাকা পরিশোধে। এখন তার তিন সন্তানসহ ৪ জনের সংসারে অভাব জেঁকে বসেছে।
সৈয়দ আলীর স্ত্রী আছমা খাতুন জানান, গ্রামে কাজ নাই। তাই সুদের উপর টাকা নিয়ে মেয়ের গাইড বই কিনে দিয়ে ছিলেন। টাকা শোধ দিতেই তাড়াহুড়া করে রওনা দেন ঢাকায় কাজের খোঁজে। ওই গ্রামের শ্রমজীবি বলরাম দাস তার স্ত্রী সাধণা রাণী ও গণ উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালিত বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণীর ছাত্রী ৬ বছর বয়সের তাদের একমাত্র মেয়ে শিল্পী রাণীকে নিয়ে ঢাকার মুন্সিগঞ্জে যা”িছল অর্থ উপার্জনে। কিš‘ এই অসমাপ্ত যাত্রায় পেট্রল বোমার আগুনে হারাতে হয়েছে তার আদরের শিশু কন্যাটিকে। অসহায় মা সাধণা রাণী। শিশুটির ব্যবহৃত জামা-কাপড় নিয়েই যেন এই শোক ভোলার চেষ্টা করছেন। একই গ্রামের রং মিস্ত্রি শাহজাহান মিয়ার ছেলে সুমন মিয়া ঢাকায় রং করার কাজে যা”িছলেন। যাওয়ার সময় গাইবান্ধার তুলসীঘাটে অবরোধ-হরতালকারিদের পেট্রোল বোমার আগুনে সুমন মিয়াও মারা যায়। তার উপার্জনেও নির্ভরশীল বৃদ্ধ পিতা শাহজাহান মিয়া ও বৃদ্ধ মা মজিদা বেগম। ফলে সন্তানকে হারিয়ে অসহায় এই বৃদ্ধ জানে না তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ হবে। তাই তাদের কান্নাও যেন থামছে না।
এ অব¯’া গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের চন্ডিপুর গ্রাম জুড়েই। কাজের সন্ধানে ঢাকা যেতে বাসে উঠে একই অব¯’া গ্রামের নিহত ৮ দরিদ্র পরিবারের। পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়ে মরতে হলো এই চন্ডিপুর গ্রামের শিশুসহ ৮ দিনমজুরকে। এরা হলেন, সৈয়দ আলী, হালিমা বেগম, সুজন মিয়া, শিল্পী রাণী, সুমন মিয়া, সোনাভান, সাজু মিয়া ও আবু কালাম। সৈয়দ আলীর মত অনেককেই দাদন ব্যবসায়ির টাকা শোধ দিতে কাজের উদ্দেশ্যে ঢাকায় যা”িছলেন। কিš‘ শুধু যাওয়াই হলো আর বাড়িতে ফেরা হলো না। কারও গায়ে ক্ষত, আর কেউ আগুনে পুড়ে নিথর কয়লা সাদৃশ্য দেহ নিয়ে বিদায় নিতে হলো পৃথিবী থেকে।
চন্ডিপুরের গৃহিনী শিল্পী বেগম জানান, নিহত ৮ পরিবারের স্বজনরাই পেট্রোলের আগুনে মানুষ হত্যাকারিদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। তারা চায় সরকার এ দরিদ্র মানুষের সন্তানদের খাওয়া পরার সুযোগ দেবে। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক এহছানে এলাহী বলেন, নিহত এবং আহতদের জন্য অর্থ সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরও সহযোগিতা করা হবে।