বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা আর নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপ নিয়ে দেশজুড়ে চলছে আলোচনা, সমালোচনা এবং বিশ্লেষণ।
সোমবার অফিস-আদালত এবং বিভিন্ন চা স্টলগুলোসহ সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রবৃন্দ ছিল মান্না-খোকার ফোনালাপ।
টেলি কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর অনেকটা অস্বস্তিতে মাহমুদুর রহমান মান্না। অনেকেই ফোন করেছিলেন পরিস্থিতি জানতে। এর মাঝে তিনি আইনি পরামর্শ করছিলেন কারো কারো সাথে। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সহিংসতা বন্ধের পাশাপাশি সংলাপ নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে তৎপর তিনি। এর মাঝে দেখা করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে। সুশীল সমাজের উদ্যোগের পেছনেও তার ভূমিকার কথা উঠে এসেছে। সোমবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে পতাকা মিছিল করতে চেয়ে ছিলেন এই নেতা। তাও আর করা হয়নি। এত কিছুর মাঝেই ফাঁস হলো বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার সাথে মান্নার টেলিসংলাপ।
তবে এই অংশটির ব্যাপারে দ্বিমত আছে তার। দাবি করছেন, আন্দোলন এগিয়ে নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো লাশ চাওয়ার কথা বলেনি তিনি।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, লাশ চাই আমি? লাশ কেন চাইতে যাব? খোকা সাহেব থাকেন আমেরিকাতে। তার সাথে ফোনে কথা হয়েছে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে। কিন্তু লাশ ফেলা নিয়ে তার সাথে কোনো কথাবার্তা হয়নি।
অপর একটি টেলিকথোপকথনে তার বিরুদ্ধে সেনা হস্তক্ষেপ নিয়ে আলোচনার অভিযোগ উঠেছে। তবে এ বিষয়টি স্বীকার করে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, কোনো জেনারেল কথা বলতে চাইলে আমি আগ্রহী।
মাহমুদুর রহমান মান্না দাবি করেন, সহিংসতা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমার রাজনীতি। তবে আমি এখন গ্রেফতারের আতঙ্কে ভুগছি।
খোকা-মান্নার ফোনালাপ : রোববারের এ টেলিসংলাপ সূত্রে জানা যায়, আমেরিকায় তখন রাত সাড়ে ১০টা। ফোনটি করেন মান্না নিজেই। সাদেক হোসেন খোকার কাছে জানতে চান, শরীর ভালো আছে কি না। রাত সাড়ে ১০টার সময় ফোন করায় বিরক্ত হচ্ছেন কি না জানতে চান মান্না। জবাবে খোকা বলেন, আমি তো রাত ২টার আগে ঘুমাতে যাই না।
মান্না: আমি যে রিপোর্ট দেয়ার কথা বলে ছিলাম সেটা কী?
খোকা: হ্যা ওটা পেয়েছি এখন পর্যন্ত স্ট্যাপল আছে, ডেটোরিয়েট করেনি।
মান্না: আচ্ছা, আচ্ছা, গুড গুড তাহলে তো ভাল।
মান্না: অফিসের সব খবর পেয়েছেন, মাঝে টুকু ভাইয়ের সঙ্গে কথাও বলেছি।
খোকা: হ্যা, একটু আগে আমার কাছে ফোন করেছিল।
মান্না : কুশল বিনিময়ের পরপরই মান্না রাজনৈতিক আলাপ শুরু করেন। সাদেক হোসেন খোকাকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে মান্না বলেন, শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা তো এখন বলা যায় না। তবে কূটনীতিকরা যেভাবে বলছেন, কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেশীদের দৃষ্টিভঙ্গিও বেশ পরিবর্তন হচ্ছে। আমি খবর পাচ্ছি। এই মুহূর্তে দরকার মাঠে যাওয়া। আপনাদের অসুবিধা বুঝতে পারছি। তবু চেষ্টা করছেন আপনারা।
খোকা : এই কর্মসূচি কতদিন নিয়মিত করা যাবে, কর্মসূচি না করেও তো উপায় দেখছি না।
টেলিসংলাপে কয়েক দফা খোকার কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না মান্না। তা জানালে খোকা আবার বলা শুরু করেন। বিএনপির চলমান আন্দোলন জেলা পর্যায়ের নেতাদের মাধ্যমে কতটা ধরে রাখা যাবে, তা নিয়ে কিছু সংশয় প্রকাশ করে খোকা বলেন, দেড় মাস হয়ে গেল, ওরা নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
মান্না বলেন, না খোকা ভাই এটা ‘কনটিনিউ’ করতেই হবে। কনটিনিউ করলে কী হবে? জানতে চান খোকা। তখন মান্না বলেন, “মাঝে যে ‘গ্রে এরিয়া’ আছে সেখানে আমাদের নামতে হবে। আমাদের বলতে সিপিবির অবস্থা অনেকটা এদিকে-অনেকটা ওদিকে। আমরা যারা আছি কজন, তাদের মধ্যেও দ্বিাধাদ্বন্দ্ব আছে। যারা নেই তাদের টানতে হবে। মাঝে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে প্রোগ্রাম আমি করেছি, তাতে অন্যরা চাঙ্গা হয়েছে। পাবলিক রেসপন্স ভালো হয়েছে। আমাদের তুলনায় এ প্রোগ্রামের রেসপন্স খুবই ভালো ছিল। আপনি যাদের যাদের বলেছিলেন, তারা আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। আমি ২৩ তারিখে গণমিছিল করতে চাইছি। এটি ঘোষণা করার আগে ভাবলাম আলাপ করি। মানুষের রাস্তার ভয়টা ভাঙানো দরকার। তাদের নামাতে হবে। মনে করছি মিছিলটা করতে পারব, পুলিশ বাধা দেবে না। দিলেও আমরা থাকব, এর পরে যা হয় হোক। আমি আপনার সাপোর্ট চাইছি, কমিটেড লোক আনতে হবে, আর পাবলিসিটি করতে হবে। মানুষ জানবে লোক আছে। আপনার লোকজনকে বলেন, এ প্রোগ্রামে তোমরা অংশ নেবে। মিছিলে ১০ হাজার লোক হলে সাড়া পড়ে যাবে, কিন্তু আমি তো পারব না। মিছিলের ব্যানার যেটাই হোক, সেখানে তো বিরোধীদের সমালোচনা করা হবে না। স্লোগান দেব- শান্তি ও সংলাপের দাবিতে।
আরটিভির টকশোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি ও নূরুল কবীর আরটিভির গোল টেবিল টকশোতে ছিলাম। এর আগে ইনডিপেনডেন্ট টকশোতে ছিলাম। আজকে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে সেই সংকটের গোড়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচন।
বিদেশি কূটনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশী কূটনীতিকরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসেছিলেন। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম নিউজটা পড়ে দেখবেন হুবহু তুলে ধরা হয়েছে।
সরকারের অবস্থান জানাতে গিয়ে মান্না বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর ‘এলার্জিক’ হয়ে আছেন। ভাবছেন, ড. কামাল এসব করতে পারবে না, যা করার আমিই করছি। ভাইবার বলে এত কথা বলছি, না হলে ওরা তো নজরদারি করছে। অনেকেই আমাকে সতর্ক করেছে।
কূটনৈতিক চাপ আরো বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে মান্না বলেন, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকান অ্যাম্বাসাডরের কথা সূক্ষ্মভাবে দেখলে বুঝবেন তারা সংলাপের কথা বলছেন। সাথে যদি ইন্ডিয়াকে যুক্ত করতে পারেন ভালো হয়। বন্ধুদের পরিবর্তন হচ্ছে।
সহিংসতা সত্ত্বেও আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে মান্না বলেন, ‘আপনাদের প্রত্যাহার করার সুযোগ নেই। এতগুলো মানুষ পেট্রলবোমায় মরেছে, তাতে মানুষ বিরক্ত হলেও ভাবছে না, বিএনপি খারাপ করছে, ওদের দমন করে ফেলো।
খোকা বলেন, সরকারের ওপর দেশি ও আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও সরকারের কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। আলোচনা বসারও উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় আন্দোলন ছাড়া বিএনপির জন্য কোনো উপায় নেই।
খোকা এসব কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে মান্না বলেন, না না, খোকা ভাই না, আপনি যা বলতে চেয়েছেন সেটা বলেন। কিন্তু কথাটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বলতে হবে। আমরা কোনো সহিংসতার মধ্যে নেই। সরকার আমাদেরকে এ রকম আন্দোলনের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এটা অবৈধ সরকার, অনির্বাচিত সরকার। সরকারের কর্মকান্ড চ্যালেঞ্জ করছি।
মান্না বলেন, আওয়ামী লীগ সহিংসতার কথা বলে। তারাও তো সহিংসতা করেছে। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) সমস্ত পরিবেশ বিবেচনা করে জনগণকে বলবেন- এই কষ্টটুকু স্বীকার করতে হচ্ছে। জনগণের কষ্টের জন্যে বিএনপি দায়ী নয়, দায়ী সরকার।
মান্না বলেন, ’৯৬ সালে নির্বাচন পরে আরেকটি নির্বাচন দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারেরও ১ বছরের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার কথা ছিল কিন্তু এখন ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়। এটাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ। সহিংসতার দূর করার জন্যে সবাই মিলে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এর পাশাপাশি বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড বন্ধ করতে হবে।
মান্নার এ কথার সূত্র ধরে খোকা বলেন, দেশের অবস্থা ভয়াবহ বিভিন্ন জায়গায় লাশ পাওয়া যাচ্ছে। এটা যেকোনো স্বাধীন সার্বভৌম দেশের চরিত্র হতে পারে না।
মান্না বলেন, এই জন্যে বিএনপিকে বলতে হবে, আমরা আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছি।
মান্না এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে খোকা বলেন, সেটাই সেটাই।
মান্না: গত চার-পাঁচ দিনে পেট্রোলবোমায় মৃত্যুর ঘটনা নেই, এটা ভালো।
খোকা : এটাও সরকারের অপপ্রচার। সরকার বলবে এটাকে তারা কন্ট্রোল করে ফেলেছে।
মান্না : এখন পর্যন্ত সরকার তা করেনি, করতে পারে। মনে হচ্ছে সরকার ভালো করে এ বিষয়টা খেয়াল করতে পারেনি। সরকার সহিংসতার কথাই বলছে।
খোকা: আপনার প্রোগ্রাম কি ২৩ তারিখ বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে?
মান্না : না, প্রেসক্লাব থেকে বিকেলে মিছিল মতিঝিলের দিকে যাবে। ধরা যাক, এই মিছিলে ১ হাজার কিংবা ৫ হাজার লোক হয়েছে সেটা বড় কথা নয় কিন্তু ঢাকায় মিছিল হচ্ছে তা ঢাকাবাসিকে জানাতে হবে। জনগণ যেন হতাশায় না ভোগে যে আওয়ামী লীগকে আর ক্ষমতা থেকে কেউ নামতে পারবে না।
সার্বিক পরিস্থিতিতে বিএনপি ডাকলে গুলশানে গিয়ে কথা বলবেন কি না জানতে চান খোকা মান্নাকে বলেন, ম্যাডাম ফোন করলে, অফিস থেকে বললে আপনারা যাবেন? জবাবে মান্না বলেন, কামাল সাহেব রাজি হবেন বলে মনে হয় না।
আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখলসহ কর্মকা- বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে মান্না বলেন, যেকোনো মূল্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চাঙ্গা করতে হবে। যদি পারা যায়, মিছিল করতে হবে। আগেও বলেছি, দু-তিনটি হল দখল করেন। কিন্তু তারা বলেছে ছাত্রদলের ও-রকম শক্তি নেই।
এ পর্যায়ে খোকা বলেন, ছাত্ররা ছাত্রদের সঙ্গে লড়াইতে হয়তো কুলাতে পারবে। কিন্তু পুলিশ ঢুকে অনেক কিছু করতে পারে। বড় ধরনের ঘটনা ঘটবে জানাতেই মান্না বলেন, গেল দুই-তিনটা, কী করা যাবেৃ। বড় ধরণের কিছু হলে ঘটনা পাল্টে যাবে। সরকার এখন সুতার ওপর চলছে। মাহমুদুর রহমান মান্না এ ছাড়া রাাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আরো অনেক পরামর্শ দেন সাদেক হোসেন খোকাকে। আগেও যোগাযোগ ছিল জানিয়ে মান্না আশ্বস্ত করেন, আগামী দিনেও যোগাযোগ রাখবেন।
মান্না: খোকা ভাই দোয়া করেন, ইনশাল্লাহ আবার কথা হবে।