বাংলাদেশের তথ্য ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা’র অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
ডেভিড বার্গম্যানের লেখা ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম হলো- ‘ফ্রি স্পিচ আন্ডার ফায়ার ইন বাংলাদেশ’ ।
প্রতিবেদনটিতে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান অন্তরায়গুলো কী তা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি বাংলাদেশে দুইজন লেখককে প্রকাশ্যে রাস্তায় হামলা চালিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছেন। এদের একজন ছিলেন অভিজিৎ রায়। যিনি কি-না একাধারে যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের বাসিন্দা।
হত্যার শিকার অন্যজন হলেন ওয়াশিকুর রহমান বাবু। তিনি চাকুরিজীবী ও ব্লগার ছিলেন।
দু:খজনক বিষয় হলো এই দুই হত্যাকা-ের মধ্যে কেবল ওয়াশিকুরের তিন খুনি ধরা পড়েন। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের ধরা হয় বলেই খুনিরা আইনের আওতায় আসেন। অন্যরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ইসলাম নিয়ে কটূক্তি বা সমালোচনাকারীদের জন্য বাংলাদেশ বর্তমানে বেশ বিপজ্জনক স্থান।
তবে মিডিয়াতে যারা কাজ করেন তারা বর্তমানে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে এতে উল্লেখ করা হয়। তবে ইসলামি জঙ্গি নয় বরং আইনের বিধিনিষেধ, অসহনীয় সরকার এবং দ্বিমত প্রকাশে আদালত অবমাননার অভিযোগগুলো এর প্রধান কারণ বলে প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়।
দেশটির দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ব্যস্ত। প্রতি টার্মে ক্ষমতার পালাবদল হলেও গত বছরেই কেবল আওয়ামী লীগ একাধারে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় বসে। আর বিএনপি তা অবৈধ বলে বয়কট করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করে।
এর ফলে সরকার প্রায় ১০ হাজার বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে আটক করে, বেশ কয়েকজন কর্মী আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
এদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগও বিএনপিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা বিএনপিকে আখ্যায়িত করছে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সন্ত্রাসী মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
এ অবস্থায় বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী এবং সরকার ও বিরোধী দলের মাঝখানে থাকা ছোট দলগুলোর নেতাকর্মীরা বিপদে রয়েছেন। কারণ তারা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা করতে পারছেন না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সমালোচনা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্টে মামলা হচ্ছে। ৫৭ ধারার ব্যবহারে সরকার বিরোধী মতকে আইসিটি অ্যাক্টের আওতায় বৃত্তবন্দী করতে চাচ্ছে।
অ্যাডভোকেট জ্যোতির্ময় আইসিটি অ্যাক্ট সম্পর্কে বলেন, এই আইনে অপরাধ বিষয়টি অস্পষ্ট এবং এ বিষয়ে সরাসরি কিছু উল্লেখ নেই। যেকোনো ব্যক্তিকে এই আইনের আওতায় আনা সম্ভব।
যারা মিথ্যা বিষয় ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল গণমাধ্যমে প্রকাশ করে কোনো ব্যক্তির সম্মান হানি বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে তাদের বিরুদ্ধে এই ধারার অধীনে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
আইসিটি অ্যাক্টে ওইসব ব্যক্তির ৭ থেকে ১৪ বছরের জেল হতে পারে। বর্তমানে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে এমন ৩০টি মামলা বিচারাধীন। আরো ২০০টির তদন্ত চলছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সম্প্রতি খুলনায় এক ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিতর্কিত প্রচারণা চালানোয় তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এছাড়া বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আদিলুর রহমানও হেফাজত-ই-ইসলামির কর্মসূচিতে ৬১ জনের প্রাণ হারানোর তথ্য প্রকাশে এই আইনের মুখোমুখি হন। এ ঘটনায় গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে দুই মাস জেলে কাটাতে হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, হেফাজতে ইসলামেরর দাবিও ছিল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার ঘটনায় নাস্তিক ব্লগারদের আইনের আওতায় আনা হোক। এ দাবির প্রেক্ষিতে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করে।
ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান বলেন, সরকার যে সমালোচনা মেনে নিতে পারছে না তা সম্পাদক ও সাংবাদিকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ২০১৪ সালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দিক থেকে ১৮০ দেশের মধ্যে ১৪৬তম স্থানে ছিল।
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে গ্রেফতার হন। এছাড়া টিভি চ্যানেলও বন্ধ ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার হুমকির কারণে।
সম্প্রতি একুশে টিভির চেয়ারম্যান আব্দুস সালামকেও গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে পর্নগ্রাফি আইনে মামলা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চ্যানেলটিতে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারের পরদিনই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
সম্পাদক সোবহান আরো বলেন, এ ঘটনায় এটাই প্রকাশ পায় যে, গণমাধ্যমগুলো সুবিবেচনায় টিকে আছে। তাই যেকোনো বক্তব্য দেওয়ার আগে ভালোভাবে ভাবতে হবে। কারণ লাইন ক্রস করা যাবে না। যদিও কেউ জানে না লাইনটা কোথায় ক্রস হয়।
গত মাসে ডেইলি স্টারে হিজবুত তাহরীরের সরকারবিরোধী একটি পোস্টার প্রকাশের পর তা সরকার সংশ্লিষ্টদের কাছে বিতর্কিত হয়।
কিছুদিন আগে পত্রিকাটির সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে এক আইনজীবী মামলা দায়ের করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এ ঘটনায় সম্পাদকের গ্রেফতার দাবি করেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এসব ঘটনাকে গণমাধ্যমকে ভয় দেখানোর প্রক্রিয়া বলে মনে করছেন।
তিনি বলেন, ডেইলি স্টার একটি জনপ্রিয় পত্রিকা। এই পত্রিকার বিরুদ্ধে সরকার লাগলে যেকোনো কিছু হতে পারতো। তাই তাকে হুমকি দিয়ে সরকার অন্য গণমাধ্যমগুলোকে প্রচ্ছন্ন হুমকির মধ্যে রাখলো।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে আদালত এবং বিচার ব্যবস্থা নিয়েও কোনো কিছু প্রকাশ করা সম্ভব না। কারণ আদালত সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশে আদালত অবমাননার অভিযোগ উঠতে পারে। এ কারণে আদালতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কেউ ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারছেন না।
তবে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর দাবি বাংলাদেশে গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা রয়েছে। মত প্রকাশে তাদের কোনো বাধাও দেওয়া হচ্ছে না।
তবে জাফর সোবহান বলেন, বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর স্বাধীনতার অবস্থা ভালো না। আমরা একটি পিচ্ছিল ঢালের মধ্যে রয়েছি। যে কারণে আজ যা গ্রহণ করছি, তা আমাদের ফ্যাকাসে আগামীকাল এনে দিতে পারে।
– See more at: http://www.sheershanewsbd.com/2015/04/20/77462#sthash.ZtiBLdCF.dpuf