সাধ্যের সবটুকুন দিয়ে চেষ্টা করেছে জুভেন্টাস। অসাধ্য সাধন করতে পারেনি তবু। তাই তো পার্থিব জগতে অপার্থিব ফুটবলের ফুল ফোটানো বার্সেলোনার সৌরভে আবারও মাতোয়ারা বিশ্ব। চ্যাম্পিয়নস লিগের মহামঞ্চ আরো একবার আলোকিত স্প্যানিশ ক্লাবটির আলোয়। আবারও ত্রিমুকুট জয়ের কালজয়ী কীর্তি তাদের।
ঘরোয়া লিগ ও কাপের দ্বিমুকুট জেতা সারা আগেই। পরশু বার্লিনে বার্সেলোনা-জুভেন্টাস দুই দলের সামনেই ছিল তাই ত্রিমুকুট জয়ের হাতছানি। এর আগে ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল ইতিহাসে যে কীর্তির চূড়া স্পর্শের কৃতিত্ব মোটে সাতটি ক্লাবের। প্রাণপণ চেষ্টায়ও ওই সপ্তকের সঙ্গে নিজেদের আর জুড়ে দিতে পারল কই জুভেন্টাস! তাদের ৩-১ গোলে হারিয়ে বরং প্রথম ক্লাব হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো ত্রিমুকুট জয়ের অত্যাশ্চর্য অর্জন এখন বার্সেলোনার।
ত্রিমুকুটের এই সাফল্য ত্রিরত্নের জাদুকরী প্রতিভার প্রতিফলন। লিওনেল মেসি, নেইমার ও লুই সুয়ারেসের। পরশু গোল পাননি বটে মেসি তবে বার্সার তিন গোলেই আক্রমণ তৈরিতে প্রত্যক্ষ অবদান তাঁর। ওদিকে নেইমারের দারুণ এক পাস প্রথম গোলের সময় খুলে দেয় জুভদের রক্ষণ। হ্যান্ডবলের অজুহাতে এরপর তাঁর এক গোল বাতিল হয় বটে তবে ম্যাচের শেষ কিকে শেষ গোল করে বার্সাকে আনন্দের সপ্তম স্বর্গে ঠিকই তুলে দেন এই ব্রাজিলিয়ান। আর লাতিন আমেরিকার ত্রিফলার শেষ জন সুয়ারেসের সুযোগসন্ধানী পা থেকে আসে ফাইনালের বাঁক নির্ণায়ক দ্বিতীয় গোল। মেসি-নেইমার-সুয়ারেসের ত্রিরত্নে এভাবেই বার্সেলোনার ত্রিমুকুটের অভিযান পায় পূর্ণতা।
ম্যাচের আবহে প্রতিপক্ষের গায়ে প্রবলভাবে সেঁটে ফেভারিটের তকমা। ধারে-ভারে যোজন এগিয়ে বার্সা। ওদিকে ইনজুরির কারণে আবার জর্জিও কিয়েল্লিনির মতো চীনের প্রাচীর ছাড়া ফাইনালে নামতে হয় ইতালিয়ান ক্লাবটিকে। এত সব চাপের যোগফলেই কিনা ম্যাচের মাত্র চতুর্থ মিনিটেই পিছিয়ে পড়ে জুভ। প্লে-মেকারের ভূমিকায় মেসির কোনাকুনি লব খুঁজে নেয় ইহোর্দি আলবাকে। তাঁর পাস নেইমারকে। বলটি একটু সময় ধরে রাখেন ব্রাজিলিয়ান, আসলে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে বিপজ্জনক জায়গায় ঢুকে পড়ার সময় দিতে। বার্সা অধিনায়ক বল পেয়ে ঠেলেন ফাঁকায় দাঁড়ানো ইভান রাকিটিচের দিকে। তাঁর শট ঠেকানোর সাধ্যি জিয়ানলুইজি বুফনের ছিল না। গোল!
প্রথমার্ধ শেষেও যে বার্সেলোনা ওই এক গোলে এগিয়ে, সেটি অবশ্য আশ্চর্যের। ব্যবধান বাড়িয়ে সেখানেই ম্যাচ শেষ করার বেশ কিছু সুযোগ পায় যে তারা! কখনো দানি আলভেসের শট অবিশ্বাস্যভাবে বাঁ-হাতে ফেরান বুফন। কখনো সুয়ারেসের প্রথম বারে নেওয়া শট ডান হাতে। ওদিকে নেইমারের ক্রস একটুর জন্য খুঁজে পায় না সুয়ারেসের মাথা। জুভেন্টাসও শুরুর ধাক্কা সামলে ম্যাচে ফেরার সুযোগ পায় দু-একবার। কিন্তু আর্তুরো ভিদালের এলোমেলো শট কিংবা পল পগবার পেনাল্টির মৃদু আবেদনে কাজের কাজ পারে না করতে।
পারল অবশেষে দ্বিতীয়ার্ধের দশম মিনিটে। ক্লাউদিও মার্কিসিওর বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাকহিল, স্টেফান লিচস্টেইনারের ক্রস, পুরো শরীর ঘুরিয়ে কার্লোস তেভেজের শট, সেটি বার্সা গোলরক্ষক মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেন কোনোক্রমে ফেরালেও ফিরতি শটে আলভারো মোরাতার গোল- যেন মুহূর্তের ঘটে যায় ব্যাপারটা। তাতে ট্রফি জয়ের অতীন্দ্রিয় মুহূর্তটা যেন বার্লিনে প্রথমবারের মতো দেখতে পায় জুভেন্টাস। পরবর্তী ১০-১৫ মিনিটের আত্মবিশ্বাসী খেলায় ছিল যার ছাপ।
কিন্তু কতক্ষণ আর! এই বার্সেলোনাকে বাক্সবন্দি করে রাখাটা যে দুঃসাধ্য! প্যান্ডেরার বাক্স থেকে কোনো না কোনো জাদুর খেল ঠিকই বের করে আনে তারা। ম্যাচের পর ম্যাচ যেমন হয়েছে, তেমনটা হলো পরশুও। ৬৮তম মিনিটে ড্রিবলিংয়ে কয়েকজনকে ছিটকে ফেলে যে শট নেন মেসি, তা কোনোমতে ফেরান বুফন। কিন্তু ফিরতি বলে সুয়ারেজের শট প্রতিরোধে একেবারে অসহায়। ঝলমলে ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপসহ প্রায় সব ট্রফি জেতা বুফনের জন্য এই চ্যাম্পিয়নস লিগ চির আক্ষেপের হয়ে থাকাটা একরকম নিশ্চিত হয়ে যায় তখন।
তবু হাল ছাড়েনি জুভেন্টাস। অসীম শক্তিধরের বিপক্ষে অসম লড়াইয়েও লড়েছে প্রাণপণ। দ্বিতীয় গোলের মিনিট চারেক পর নেইমারের লক্ষ্যভেদ যখন হ্যান্ডবলের অজুহাতে বাতিল করা হয়, ফুটবল বিধাতার পক্ষপাতে একটু হয়তো আশার আলো দেখে তারা। কিন্তু টিমটিমে ওই প্রদীপ আর মশাল হয়ে জ্বলেনি। শেষ দিকে মার্কিসিওর প্রচেষ্টা দারুণভাবে ফেরান টের স্টেগেন, তেভেজের শট ছিল অবশ্য একেবারে সোজাসুজি। উল্টো ইনজুরি সময়ের সপ্তম মিনিটে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে মেসি-পেদ্রোর সহায়তায় গোল করে বার্সেলোনার শ্রেষ্ঠত্বের নিশান ওড়ানো নিশ্চিত করেন নেইমার।
এরপর? প্রথম মৌসুমেই কোচ হিসেবে অবিশ্বাস্য সাফল্য এনে দেওয়া লুই এনরিকেকে নিয়ে মাতামাতি হলো বেশ। ঝলমলে বার্সেলোনা ক্যারিয়ারে শেষ ম্যাচ খেলা জাভি এর্নান্দেসকে নিয়েও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বার্সেলোনার এই সাফল্যের মধ্যমণি হয়ে রইলেন ওই তিনজনই। মেসি-নেইমার-সুয়ারেসের ত্রিফলা!